জুম’আহ এর দিন নিয়ে আমাদের যা জানা উচিত

Table of Contents

ভূমিকা

আমরা সবাই জামাতে জুম’আর নামায পড়তে ভালোবাসি। আসুন, এ দিন সংক্রান্ত কিছু আয়াত ও সহী হাদিস আলোচনা করা যাক:

পবিত্র কুরআন শরীফে একটি সম্পূর্ণ সূরাই রয়েছে এই দিনটি নিয়ে (সূরা আল জুমুআহ)

দিনটির উৎপত্তি:

এই দিনেই আমরা তৈরি হয়েছি – অবতীর্ণ হয়েছি  – পুনরুত্থিত হবো

সহীহ মুসলিম অধ্যায়ঃ ৮। জুমু’আহ, হাদীস ১৮৬২:

কুতায়বাহ ইবনু সাঈদ (রহঃ) ….. আবূ হুরায়রাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন সূর্য উদিত হওয়ার দিনগুলোর মধ্যে জুমুআর দিন সর্বোত্তম। এ দিন আদাম (আঃ) কে সৃষ্টি করা হয়েছে, এ দিন তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে এবং এ দিন সেখান থেকে তাকে বের করে দেয়া হয়েছে, জুমুআর দিনই কিয়ামাত সংঘটিত হবে।

সুতরাং, এই দিনেই মানব জাতির সৃষ্টি, এই দিনেই পৃথিবীতে মানব জাতির অবতরণ, এবং এই দিনেই আমরা আবার পুনরুত্থিত হবোএই দিনটির জামাত যেন, কিয়ামতের দিন সবাই একসাথে আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) সামনে দাঁড়ানোর একটি সিমুলেশন/আদিখেত্যা।

ইহুদী ও খ্রীষ্টানরা দিবসটি শনিবার ও রবিবার-এ পরিবর্তিত করেছে

সহীহ আল-বুখারী, অধ্যায়ঃ ১১/ জুমু‘আহ, হাদীস ৮৭৬:

আবূ হুরাইরাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে বলতে শুনেছেন যে, আমরা দুনিয়ায় (আগমনের দিক দিয়ে) সর্বশেষ, কিন্তু ক্বিয়ামাতের দিন আমরা মর্যাদার ব্যাপারে সবার পূর্বে। ব্যতিক্রম এই যে, আমাদের পূর্বে তাদের কিতাব প্রদান করা হয়েছে। অতঃপর তাদের সে দিন যে দিন তাদের জন্য ইবাদত ফরজ করা হয়েছিল তারা এ বিষয়ে মতভেদ করেছে। কিন্তু সে বিষয়ে আল্লাহ্ আমাদের হিদায়াত করেছেন। কাজেই এ ব্যাপারে লোকেরা আমাদের পশ্চাদ্বর্তী। ইয়াহূদীদের (সম্মানীয় দিন হচ্ছে) আগামী কাল (শনিবার) এবং নাসারাদের আগামী পরশু (রোববার)।

তাই, ইহুদীদের আসল পবিত্র ধর্মগ্রন্থ (তৌরাত) এবং খ্রিস্টানদের (ইঞ্জিল) অনুসারে এই দিনটি তাদের জন্য বাধ্যতামূলক উৎসবের দিন ছিল, যা তারা হয় ভূলে গেছে বা ইচ্ছাকৃত বদলে দিয়েছে।

আমাদের যা জানা উচিত:

আযান দেয়ার পর ব্যাবসায়িক লেনদেন সম্পূর্ণ নিষেধ

সূরা জুমুআহ, আয়াত ৯ অনুযায়ী:

মুমিনগণ, জুমআর দিনে যখন নামাযের আযান দেয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের পানে ত্বরা কর এবং বেচাকেনা বন্ধ কর। এটা তোমাদের জন্যে উত্তম যদি তোমরা বুঝ।

সুতরাং, জুমুআহ-এর  আযান দেয়ার সময় থেকে নামায সমাপ্ত হওয়ার সময় পর্যন্ত যে কোনো প্রকৃতির ব্যবসা / পার্থিব লেনদেনের সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ, তাই আমরা যেন নামাযে শেষ হওয়ার আগে একটা টুপি বা আতরও না কিনি।

বিঃ দ্রঃ দয়া করে মনে রাখবেন, এই আযানটি আমাদের মসজিদে আরবি খুতবা শুরু করার ঠিক আগের নিকটস্থ আযানেটি হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

জুমুআহ-এর নামাজ অবহেলা আমাদের হৃদয় মোহর মেরে দিবে

সহীহ মুসলিম অধ্যায়ঃ ৮। জুমু’আহ, হাদীস ১৮৭৫:

আবদুল্লাহ ইবনু উমর ও আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, তাঁরা উভয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে মিম্বরের সিঁড়িতে বলতে শুনেছেন, যারা জুমু’আহ পরিত্যাগ করে, তাদেরকে এ কাজ হাত অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। নতুবা আল্লাহ তাদের অন্তরে মোহর মেরে দিবেন। অতঃপর তারা অবশ্যই গাফিলদের অন্তরভুক্ত হয়ে যাবে।

সুতরাং, আমাদের জুমুআহ-এর নামায আদায় করা নিয়ে কোনো অবস্থাতেই অবহেলা করা চলবে না নতুবা আমাদের অন্তরে আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) মোহর মেরে দিতে পারে।

দিনটি উদযাপন করার নির্ধারিত নিয়ম:

গোসল করা অবশ্যক

সহীহ আল-বুখারী, অধ্যায়ঃ ১১/ জুমু‘আহ, হাদীস ৮৭৭

‘আবদুল্লাহ্ ইবনু ‘উমার (রাযি.) হতে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের মধ্যে কেউ জুমু‘আহর সালাতে আসলে সে যেন গোসল করে।”

সুতরাং, জুমুয়াহ-এর নামাযের পূর্বে আমাদের গোসল করা বাধ্যতামূলক।

দৌড় দিয়েন না শুধু হাঁটুন

সহীহ আল-বুখারী, অধ্যায়ঃ ১১/ জুমু‘আহ, হাদীস ৯০৮

আবূ হুরাইরাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে বলতে শুনেছি, যখন সালাত শুরু হয়, তখন দৌড়িয়ে গিয়ে সালাতে যোগদান করবে না, বরং হেঁটে গিয়ে সালাতে যোগদান করবে। সালাতে ধীর-স্থিরভাবে যাওয়া তোমাদের জন্য অপরিহার্য। কাজেই জামা‘আতের সাথে সালাত যতটুকু পাও আদায় কর, আর যা ছুটে গেছে, পরে তা পূর্ণ করে নাও।

সুতরাং, আমাদের কখনো মসজিদে দৌড়িয়ে যাওয়া উচিৎ না বরং যদি নামাযে দেরীও হয়ে যায় তবুও শান্ত ভাবে হেঁটে যাওয়া উচিৎ।  

মসজিদ আগে আসুন

সহীহ আল-বুখারী, অধ্যায়ঃ ১১/ জুমু‘আহ, হাদীস ৮৮১

আবূ হুরাইরাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি জুমু‘আহর দিন জানাবাত গোসলের ন্যায় গোসল করে এবং সালাতের জন্য আগমন করে সে যেন একটি উট কুরবানী করল। যে ব্যক্তি দ্বিতীয় পর্যায়ে আগমন করে সে যেন একটি গাভী কুরবানী করল। তৃতীয় পর্যায়ে যে আগমন করে সে যেন একটি শিং বিশিষ্ট দুম্বা কুরবানী করল। চতুর্থ পর্যায়ে আগমন করল সে যেন একটি মুরগী কুরবানী করল। পঞ্চম পর্যায়ে যে আগমন করল সে যেন একটি ডিম কুরবানী করল। পরে ইমাম যখন খুত্বাহ দেয়ার জন্য বের হন তখন মালাইকাহ যিকর শ্রবণের জন্য উপস্থিত হয়ে থাকে।

সুতরাং,যে ব্যক্তি শুক্রবারে প্রাথমিক পর্যায়ে  আসে তারা একটি উট কুরবানীর সওয়াব পায় এর পরে আসলে একটি গাভী → একটা ভেড়া →একটি মুরগি → একটি ডিমের এর সওয়াব পাবে।

দখুলুল মসজিদ / তাহিয়াতুল-উল মসজিদ

সহীহ আল-বুখারী, অধ্যায়ঃ ১১/ জুমু‘আহ, হাদীস ৯৩১

জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক জুমু‘আহর দিন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুৎবাহ দেয়ার সময় এক ব্যক্তি প্রবেশ করলে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, সালাত আদায় করেছ কি? সে বলল, না; তিনি বললেনঃ উঠ, দু’ রাক‘আত সালাত আদায় কর।

সুতরাং, খুতবা শুরু হয়ে গেলেও আমাদের মসজিদে ঢুকে সংক্ষেপে ২ রাকাত সুন্নত নামায আদায় করা উচিৎ।

খুতবা চলাকালীন সময় কথা বলা নিষেধ

সহীহ আল-বুখারী, অধ্যায়ঃ ১১/ জুমু‘আহ, হাদীস ৯৩৪

সালমান ফারসী (রাযি.) নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন, যখন ইমাম কথা বলবেন, তখন চুপ থাকবে। আবূ হুরাইরাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ জুমু‘আহর দিন যখন তোমার পাশের মুসল্লীকে চুপ থাক বলবে, অথচ ইমাম খুৎবাহ দিচ্ছেন, তা হলে তুমি একটি অনর্থক কথা বললে।

সুতরাং, আমাদের খুতবা চলাকালীন সময় কথা বলা বা আলাপ করা উচিৎ না।

নামাযের জন্য আগে থেকেই দাঁড়িয়ে যাওয়া উচিৎ নয়

সহীহ আল-বুখারী, অধ্যায়ঃ ১১/ জুমু‘আহ, হাদীস ৯০৯

আবূ ক্বাতাদা (রাঃ) সূত্রে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেনঃ তোমরা আমাকে না দেখা পর্যন্ত সালাতে দাঁড়াবে না। তোমাদের জন্য ধীর-স্থির থাকা অত্যাবশ্যক।

সুতরাং, আমাদেরকে খুতবা শেষ করে ইমাম সাহেব এর দাঁড়ানো পর্যন্ত অপেক্ষা করে তারপর নামাযের জন্য দাঁড়ানো উচিৎ। আমাদের মধ্যে অনেকে খুতবার শেষ অংশ জানা থাকায় মাঝে মধ্যে আগেই দাঁড়িয়ে পরি।

জুমু’আর পরবর্তী (সুন্নাত) সালাত

সহীহ মুসলিম অধ্যায়ঃ ৮। জুমু’আহ, হাদীস ১৯২১

ইয়াহয়া ইবনু ইয়াহয়া (রহঃ) … আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের কেউ জুমুআর সালাত আদায় করলে তারপর চার রাকআত সালাত আদায় করবে।

সুতরাং, দুই রাকাত  ফরজ নামায জামাতে পড়ার পর চার রাকাত সুন্নত নামায পড়া উচিৎ।

শুক্রবার মধ্যবর্তী পাপমুছে ফেলা হয়

সহীহ আল-বুখারী, অধ্যায়ঃ ১১/ জুমু‘আহ, হাদীস ৮৮৩

সালমান ফারিসী (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি জুমু‘আহর দিন গোসল করে এবং যথাসাধ্য ভালরূপে পবিত্রতা অর্জন করে ও নিজের তেল হতে ব্যবহার করে বা নিজ ঘরের সুগন্ধি ব্যবহার করে, অতঃপর বের হয় এবং দু’ জন লোকের মাঝে ফাঁক না করে, অতঃপর তার নির্ধারিত সালাত আদায় করে এবং ইমামের খুৎবা দেয়ার সময় চুপ থাকে, তা হলে তার সে জুমু‘আহ হতে আরেক জুমু‘আহ পর্যন্ত সময়ের যাবতীয় গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।

সুতরাং, নির্ধারিত নিয়মে জুমুআহ-এর নামায আদায় করলে, পরবর্তী জুমুআহ পর্যন্ত যাবতীয় গুনাহ মাফ হয়ে যায়।

জুমু’আর পরে দুপুরের শয়ন ও হালকা নিদ্রা

সহীহ আল-বুখারী, অধ্যায়ঃ ১১/ জুমু‘আহ, হাদীস ৯৪১

সায়ীদ ইবনু আবূ মারইয়াম (রহঃ) … সাহল (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে জুমু’আর সালাত (নামায/নামাজ) আদায় করতাম।

সুতরাং, আমরা  জুমুআহ-এর নামাযের পর দুপুরে একটি হালকা ঘুম/নিদ্রায় গিয়ে একটি সুন্নত পালন করে নিতে পারি।