সূরা আন-নাস

একটি সংক্ষিপ্ত ভূমিকা

 

মানুষ সবসময় শয়তানের অশুভ প্রলোভনে উন্মুক্ত থাকে, যা আমাদের হৃদয় প্রবেশ করতে পারে। নবী মুহাম্মদ (সাঃ), আমাদের নেতা ও সর্বোত্তম শিক্ষক হিসেবে, এই সূরাটির দ্বারা আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, আমরা কিভাবে এসব কুমন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে পারি।

এই সূরাটির বিষয়বস্তু এর পূর্ববর্তী সূরা আল-ফালাকের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

আয়িশাহ (রাঃ), বর্ণনা করেছেন,

নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কখনও অসুস্থ বোধ করলে আরোগ্য লাভের জন্য সূরা ফালাক ও সূরা নাস পড়ে নিজ দেহে ফুঁ দিতেন। তাঁর অসুস্থতা বেড়ে গেলে আমি তা তাঁর উপর পাঠ করতাম এবং তাঁর হাত তাঁর দেহে (সূরাটির বরকতের আশায়) মাসেহ করে  দিতাম।

{তাহকীক আলবানীঃ সহীহ সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৩৫২৯}

আয়িশাহ (রাঃ) আরো বর্ণনা করেছেন,

নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন শয্যা গ্রহণ করতেন, তখন সূরা ফালাক ও সূরা নাস পড়ে তাঁর দু’ হাতে ফুঁ দিয়ে তা তাঁর সমস্ত শরীর মাসেহ করে নিতেন।

{সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ৩৮৭৫}

আমাদের নবীর ওপর জাদু করা হয়েছিল

আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উপর জাদু করা হয়েছিল, যাতে তিনি কল্পনা করতেন যে, তিনি একটি কাজ করছিলেন যা আসলে তিনি করেছিলেন না (এটা এক ধরনের বিভ্রম ছিল)। আবু সুফিয়ান বলেছেন, “এটি জাদুর সবচাইতে খারাপ পর্যায়”।

‘আয়িশাহ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন,

তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) – এর উপর  যাদু করা হয়। তাঁর মনে হতো তিনি একটি কাজ করেছেন, আসলে তিনি তা করেননি (এটা উনার বিভ্রম ছিল)। তিনি এ বেপারে আল্লাহ্‌র নিকট বার বার দু’আ করলেন। তারপর ঘুম থেকে জেগে বললেনঃ হে ‘আয়িশাহ! তুমি কি বুঝতে পেরেছ? আমি যে বিষয়ে তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তিনি তা আমাকে জানিয়ে দিয়েছেন। আমি বললামঃ হে আল্লাহর রসূল! তা কী? তিনি বললেনঃ আমার নিকট দু’জন লোক (ফেরেস্তা) এলেন। তাঁদের একজন আমার মাথার নিকট এবং আরেকজন আমার পায়ের নিকট বসলেন। তারপর একজন অন্যজনকে  জিজ্ঞেস করলেনঃ এ লোকটির কী হয়েছে? তিনি উত্তর দিলেনঃ তাঁকে যাদু করা হয়েছে। প্রথমজন বললেনঃ কে তাঁকে যাদু করেছে? দ্বিতীয় জন বললেন, লাবীদ ইবনু আ’সাম নামক ইয়াহূদী। প্রথমজন জিজ্ঞেস করলেনঃ যাদু কী দিয়ে করা হয়েছে? দ্বিতীয়জন বললেনঃ চিরুনী, চিরুনী আঁচড়াবার সময় উঠে আসা চুল ও নর খেজুর গাছের ‘জুব’ এর মধ্যে। তখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সহাবীদের কয়েকজনকে নিয়ে ঐ কূপের নিকট গেলেন এবং তা ভাল করে দেখলেন। কূপের পাড়ে ছিল খেজুর গাছ। তারপর তিনি ‘আয়িশাহ (রাঃ) এর নিকট ফিরে এসে বললেনঃ আল্লাহ্‌র কসম! কূপটির পানির (রঙ) মেহদী মিশ্রিত পানির মতো। আর পার্শ্ববর্তী খেজুর গাছের মাথাগুলো শয়তানের মাথার মতো। আমি বললামঃ হে আল্লাহর রসূল! আপনি কি সেগুলো বের করবেন না? তিনি বললেনঃ না, আল্লাহ আমাকে আরোগ্য ও শিফা দান করেছেন, মানুষের মধ্যে এ ঘটনা থেকে মন্দ ছড়াতে আমি পছন্দ করি না। এরপর তিনি যাদুর দ্রব্যগুলোর ব্যাপারে নির্দেশ দিলে সেগুলো মাটিতে পুঁতে রাখা হয়।

{সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৫৭৬৬}

 

সূরা আন-নাস এর সংক্ষিপ্ত অর্থ:

আল্লাহ পরম করুণাময়, পরম দয়ালু নামে শুরু

১. বলুন, আমি আশ্রয় গ্রহণ করিতেছি মানুষের পালনকর্তার,

২. মানুষের অধিপতির,

৩. মানুষের মাবুদের

৪. তার অনিষ্ট থেকে, যে কুমন্ত্রণা দেয় ও আত্নগোপন করে,

৫. যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে(বুকে)

৬. জ্বিনের মধ্য থেকে অথবা মানুষের মধ্য থেকে।

সূরা আল-ফালাক্ব এর সংক্ষিপ্ত অর্থ:

আল্লাহ পরম করুণাময়, পরম দয়ালু নামে শুরু

১. বলুন, আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি প্রভাতের পালনকর্তার,

২. তিনি যা সৃষ্টি করেছেন, তার অনিষ্ট থেকে,

৩. অন্ধকার রাত্রির অনিষ্ট থেকে, যখন তা সমাগত হয়,

৪. গ্রন্থিতে ফুঁৎকার দিয়ে জাদুকারিনীদের অনিষ্ট থেকে

৫. এবং হিংসুকের অনিষ্ট থেকে যখন সে হিংসা করে।

 

আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) চমৎকার ৩টি নাম উল্লেখিত হয়েছে

“বলুন, আমি আশ্রয় গ্রহণ করিতেছি মানুষের পালনকর্তার,”

“মানুষের অধিপতির”

“মানুষের মাবুদের”

এখানে “বলুন“(কুল) শব্দটি, দ্বারা: আল্লাহ(সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) মানব জাতিকে তাদের নিজের মুখে তাদের দুর্বলতা ও অক্ষমতা ঘোষণা করতে আদেশ দিয়েছেন।

সূরাটির প্রথমেই, আল্লাহ(সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) ৩টি মহৎ বৈশিষ্ট্যাবলী – কর্তৃত্ব, মালিকানা, এবং প্রভুত্ব – উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি সবকিছুর মালিক, শাসক, প্রভু ও পালনকর্তা। তাঁর সৃষ্টির মধ্যে আমরা(মানব জাতিও) অন্তর্ভুক্ত।

৩টি ঘোষণা:

‘মানবজাতির পালনকর্তা‘: ঘোষণা করে আমরা তাঁর প্রভুত্বের স্বীকার করে নিজেদেরকে তাঁর নির্দেশের অধীনস্ত করি।

‘মানবজাতির অধিপতি‘: ষোষণা করে আমরা নিজেদেরকে তাঁর সম্পত্তি ও ক্রীতদাস হিসেবে অনুধাবন করি।

‘মানুষের মা’বুদ‘: ঘোষণা দিয়ে আমরা একমাত্র তাঁরই উপাসনা করি এবং তাঁকে ছাড়া অন্য কারো উপাসনা বা সাহায্য প্রার্থনা থেকে নিজেকে বিরত রাখি।

নিঃসন্দেহে, যে ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে এই তিনটি বৈশিষ্ট্য সঠিকভাবে অনুধাবন ও বিশ্বাস করে, আত্মরক্ষা চাইবে, নিশ্চই তিনি এসব কুমন্ত্রণা থেকে বেঁচে থাকতে পারবে (ইনশাআল্লাহ)।

 

কেন আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা)থেকে আশ্রয় চাওয়া হয়

আমরা প্রথমেই, আমাদের পালনকর্তা/অধিপতি/মা’বুদ এর কাছে আমাদের অক্ষমতা স্বীকার করি, কারণ আমাদের আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) সর্বক্ষণিক সাহায্য প্রয়োজন। আমরা নিজেরা কোনো অবস্থাতেই এই পরিস্থিতির মুকাবিলা করতে সক্ষম নই।

নিজেকে একটু প্রশ্ন করে দেখুন, কোনো প্রকার ঐশ্বরিক সাহায্য বা পথনির্দেশনা/পরিচালনা ছাড়া, আপনি কি নিজেকে এ রকম অশুভ পথ থেকে রক্ষা করতে সক্ষম? আমি ১০০% থেকেও বেশি নিশ্চিত যে আপনার উত্তর না সূচক হবে (আমরা নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম নই)।

আমাদের নিজেদেরকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করা কোনো ভাবেই উচিৎ না:

সত্যি সত্যি মানুষ সীমালংঘন করে, এ কারণে যে, সে নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করে।

{সূরা আলাক আয়াত ৬-৭}.

 

সূরাটি কেবল মুখে আবৃত্তি না করে এটি আমাদের বিশ্বাস, চেতনায় কার্যকলাপে সাধন করা উচিৎ। আমাদের সব ধরণের খারাপ চিন্তা, কার্যকলাপ, সঙ্গ, যোগাযোগ ইত্যাদি, যতটা সম্ভব, ত্যাগ করে, তারপর আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা উচিৎ। তা নাহলে, আমরা সেসব কু-প্ররোচনার শিকার হয়ে যেতে পারি।

 

নাস শব্দটির অর্থ

নাস শব্দটির কয়েকটি অর্থ আছে; এর একটি উৎপত্তি “নাসিয়া” শব্দ থেকে হয়েছে – যার অর্থ হলো ভুলে যাওয়া।

মানুষ ইতিমধ্যে আল্লাহর কাছে তাদের অঙ্গীকার ভুলে গিয়েছে, তাই তাদেরকে  নাস বলা হয়:

আমাদের আত্মা যখন প্রথম সৃষ্টি করা হয়েছিল তখন আল্লাহর কাছে  আমরা সাক্ষ্য দিয়েছিলাম-

আমাদেরকে(আদম সন্তানদেরকে) আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) প্রশ্ন করেছিল, আমি কি তোমাদের পালনকর্তা নই? আমরা বলেছিলাম, অবশ্যই, আমরা অঙ্গীকার করছি। তিঁনি বলেছিলেন, আবার কেয়ামতের দিন না বলতে শুরু কর যে, এ বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না।

{সূরা আল-আ’রাফ আয়াত ১৭২}

আল্লাহ(সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) শয়তানকে একটি ক্ষমতা দিয়েছেন, সে মানুষকে ভুলিয়ে দিতে পারে। সবচেয়ে বড় বেপার যা মানুষ সবসময় ভুলে যায় তা হলো আল্লাহ(সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) তাদেরকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করছে ও তাদের কার্যকলাপের রেকর্ড রাখছে।

যেগুলো থেকে আশ্রয় চাওয়া হয়

“তার অনিষ্ট থেকে, যে কুমন্ত্রণা দেয় ও আত্নগোপন করে,”

“যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে”

“জ্বিনের মধ্য থেকে অথবা মানুষের মধ্য থেকে।”

অশুভ প্রলোভনের কুমন্ত্রণা দেয় ও আত্নগোপন করে,

অশুভ(শারৱ) – শব্দটির অর্থ হলো খারাপ যা ক্ষতি সাধন করতে পারে

অশুভ প্রলোভনের কুমন্ত্রণা দেয় ও আত্নগোপন করে,

শয়তান, ও তাদের অশুভ কুমন্ত্রণা অপ্রকাশিত(লুকানো) প্রকৃতির হয়। গুঞ্জন/ফিস্-ফিস্ (ওয়াস-ওয়াস) করে মানুষকে কুমন্ত্রণাগুলো দেয়া হয়, এভাবে যেন আমরা এগুলোকে আমাদের নিজেস্ব চিন্তার ধারণা মনে করি (প্রকৃতপক্ষে সেগুলো আমাদের চিন্তা নয়)। এসব চিন্তাই আসলে আমাদের ক্ষতি সাধন করে। এসব অশুভ গুঞ্জন আমাদেরকে ষড়যন্ত্র, মিথ্যা, ক্ষতি, কুটিল, জালিয়াতি, প্রতারণা , সত্য গোপন, অধিকার হনন ইত্যাদি করতে প্ররোচিত করে।

হযরত আলী (আঃ) বেখ্যা দিয়েছেন,

“যদি  এসব অশুভ প্ররোচণা  মানুষের দৃশ্যমান হতোই, মানুষ অতি সহজেই সেগুলো থেকে দূরে থাকতে পারতো

অশুভ প্রলোভনের কুমন্ত্রণা দেয় ও আত্নগোপন করে,

প্ররোচনাকারী প্ররোচণা দেয় ও আত্মগোপন/পলায়ন (খান্নাস) করে। আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) স্মরণে শয়তান তার কাজ থেকে অব্যহতি দেয় / পলায়ণ করে / আত্মগোপন করে। শয়তান তার পরিকল্পনা মানুষের হৃদয় উপরে স্থাপন করে আর যখনই আমরা ভুলে যাই, অন্যমনস্ক বা অসাবধান হয়ে যাই – শয়তান আমাদের হৃদয় কুমন্ত্রণা দেয়ার সুযোগ পেয়ে যায়।

 

একটি করে শয়তান আমাদের প্রত্যেকের জন্য নিযুক্ত করা আছে:

একটি করে শয়তান প্রত্যেক মানুষের জন্য নিযুক্ত করা হয়। এমন কোনো আদম সন্তান নেই যার সাথে একটি সহচরী নাই যে তার অশুভ কার্যকলাপ সৌন্দর্যসাধন করে। শয়তান আমাদেরকে বিভ্রান্ত ও হতবুদ্ধি করার ক্ষেত্রে যথাসাদ্ধ পর্যায়ে প্রচেষ্টা চালাতে পারে। শুধুমাত্র আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) যাদেরকে রক্ষা করবেন তারাই নিরাপদ।

আবদুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন,

তিনি বলেন, রসূলূল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ তোমাদের প্রত্যেকের সাথেই একটি শাইতান নির্ধারিত আছে। সহাবাগণ প্রশ্ন করলেন, হে আল্লাহর রসূল! আপনার সাথেও কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমার সাথেও। তবে তার মুকাবিলায় আল্লাহ আমাকে সাহায্য করেছেন। এখন আমি তার সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে নিরাপদ। এখন সে আমাকে কল্যাণকর বিষয় ছাড়া কক্ষনো অন্য কিছুর নির্দেশ দেয় না।

{সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৭০০১}

 

অন্য একটি হাদীসে সাফিয়্যাহ বিন্‌তু হুয়াই (রাঃ) বর্ণনা করেছেন,

আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে পৌঁছে দেয়ার জন্য আমার সঙ্গে যাচ্ছিলেন। এ সময় দু’জন আনসারী সে স্থান দিয়ে অতিক্রম করছিলো। তারা যখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে দেখল তখন তারা শীঘ্র চলে যেতে লাগল। তখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, তোমরা একটু থাম। এ হলো সাফিয়্যা বিন্‌তে হুয়াই। তারা বললেন, সুবহানাল্লাহ! হে আল্লাহ্‌র রসূল (আমরা আপনাকে সন্দেহ করি কিভাবে) তিনি তখন বললেন, মানুষের রক্তধারার মতো শয়তান প্রবাহমান থাকে। আমি শঙ্কাবোধ করছিলাম, সে তোমাদের মনে কোন খারাপ ধারণা অথবা অন্য কিছু সৃষ্টি করে না কি।

{সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৩২৮১}

 

যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে(বুকে):

লক্ষ্য করে দেখুন “ইউওয়াসউইসু” (কুমন্ত্রণা) শব্দটি আবার ব্যবহৃত করে আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আমাদের বোঝাতে চেয়েছে যে এসকল কুমন্ত্রণার গুঞ্জন বারবার পুনরাবৃত্তি করা হয়। শয়তান এ কাজটি অতি চমৎকার ভাবে করতে পারে এবং কখনো থামে না বা অব্যাহতি দেয় না।

এইখানে, সুদুর (বুক) শব্দ বেবহার করা হয়েছে। আব্দুর রহমান খিলানি তার তাফসীর – মুতারাদিফ আল কুরআন এ, বলেছেন বুকে গুঞ্জন করা ও হৃদয়-এ গুঞ্জন করা এক নয়।

অর্থটি বুঝতে একটি উদাহরণ কল্পনা করুন-

ধরুন হৃদয় একটি দুর্গ, আর দুর্গের (হৃদয়ের) চারিপাশের ক্ষেত্র হলো আমাদের বুক

শয়তানের এই ক্ষেত্রে (বুকে) প্রবেশাধিকার আছে – হৃদয়ের চারিদিকে – শয়তান কোনোভাবে দুর্গের ভেতরে ঢোকার ক্রমাগত চেষ্টায় থাকে। কিন্তু দুর্গটি আটকানো/তালাবদ্ধ। তাই শয়তানের আমাদের হৃদয়ে পৌঁছনোর কোনো ক্ষমতা নাই (সে শুধু আমাদের বুকে গুঞ্জন করতে পারে)।  

একমাত্র আপনার কাছেই দুর্গের চাবি বা প্রবেশাধিকার দেয়ার ক্ষমতা দেয়া আছে। আর আমরা যদি আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) কাছে বিনীতভাবে আশ্রয় প্রার্থনা করি, তাহলে শয়তান পালিয়ে যায়, এবং আবার আক্রমণ করার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

আর আপনি যদি তাকে একবার হৃদয়ে ঢুকতে দেন, তাহলেই সে আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলাকে) আপনার কাছ থেকে দূরে করে দিবে এবং আপনার কাছে অশুভ কার্যকলাপ বা চিন্তা-ধারণা সুন্দর, আকর্ষণীয় ও অনিবার্য করে তুলবে।

 

জ্বিনের মধ্য থেকে অথবা মানুষের মধ্য থেকে:

অশুভ কুমন্ত্রণার গুঞ্জন উভয় জীন জাতি বা মানব জাতি থেকেই হতে পারে।

 

এই বিষয়ে দুই রকমের মতামত আছে:

  • কুমন্ত্রণা দানকারী একটি অদৃশ্য জীন বা মানুষ রূপে জীন হতে পারে
    • যেমন ইবনে জারীর বলেছিলেন “রিজালুন মিন আল-জীন” -মানে মানুষ রূপে জীন
  • কুমন্ত্রণা দানকারী একটি জীন বা একটি বাস্তব মানুষ হতে পারে – আমরা মাঝে মাঝে অন্য মানুষের উস্কানিমূলক কাজ দেখে বা কথা শুনে অশুভ কাজ বা চিন্তার শুরু করি
    • বেপারটি, এ আয়াতটির সাথে সামঞ্জস্য: এমনিভাবে আমি প্রত্যেক নবীর জন্যে শত্রূ করেছি শয়তান, মানব ও জিনকে। তারা ধোঁকা দেয়ার জন্যে একে অপরকে কারুকার্যখচিত কথাবার্তা শিক্ষা দেয়।…{সূরা আল-আন’আম আয়াত ১১২}

এসব কুমন্ত্রণাদানকারীর বিরুদ্ধে, আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) স্বর্গীয় ফেরেস্তা রয়েছে তাঁর  বিশ্বাসী বান্দাদের সাহায্যের জন্যে, আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেন,

“নিশ্চয় যারা বলে, আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ, অতঃপর তাতেই অবিচল থাকে, তাদের কাছে ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় এবং বলে, তোমরা ভয় করো না, চিন্তা করো না…

{সূরা ফুছছিলাত, আয়াত ৩০}

কিন্তু, কোনো অবস্থাতেই, আমাদের কখনোই একথা মনে করা উচিৎ না যে আমাদের ঐশরিক শিক্ষা, সতর্কীকরণ ও সহায়তা প্রয়োজন নাই। আমাদের সবসময় আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) কাছে আশ্রয় চাওয়া উচিৎ ও সর্বদা সতর্ক ও প্রস্তুত থাকা উচিৎ।

 

আন-নাস এবং আল-ফাতিহার মিল:

  1. আল্লাহর ৩টি বৈশিষ্ট্যাবলী উভয় সূরায় (কর্তৃত্ব, মালিকানা, এবং প্রভুত্ব) পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে।
  2. পথপ্রদর্শনার প্রেক্ষাপটে-
    1. আল-ফাতিহার- আমরা আল্লাহর কাছে সরল পথের পথপ্রদর্শনা চাই
    2. আন-নাস – আমরা আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই শয়তান থেকে যারা আমাদেরকে আল্লাহর পথপ্রদর্শনা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়
  3. আশ্রয়ের প্রেক্ষাপটে-
    1. আল-ফাতিহা- সমষ্টিগত/গোষ্ঠীবদ্ধ সুরক্ষা চাই (“আমরা/আমাদের” শব্দ বেবহার করে)
    2. আন-নাস – বেক্তিগত সুরক্ষা চাই (“আমি/আমাকে” শব্দ ব্যবহার করে)
  4. দুটি অশুভ প্রভাব থেকে:
    1. আন-নাস – খারাপ জীন ও মানবজাতির অশুভ প্ররোচণা থেকে
    2. আল-ফাতিহা: পুথভ্রষ্ট মানুষের বিভ্রান্তি থেকে
      1. স্বেচ্ছায় পথভ্রষ্ট (যেমন ইহুদী), যাদের কাছে সত্যের জ্ঞান আছে এবং;
      2. মূর্খ অবস্থায় পথভ্রষ্ট (যেমন খ্রিস্টান), যারা সত্য জানেনা
  5. উভয় সূরা দুই ভাগে বিভক্ত:
    1. আন-নাস-
      1. ১ম অংশ – আমরা কার[আল্লাহর] কাছ থেকে সুরক্ষা চাই
      2. ২য় অংশ – আমরা কিসের[শয়তানের এর কুমন্ত্রণা] থেকে সুরক্ষা চাই
    2. আল-ফাতিহা-
      1. ১ম অংশ – কেন আমরা আল্লাহর উপাসনা করি
      2. ২য় অংশ – কিভাবে আমরা উপাসনা করি (পথপ্রদর্শনার মাধ্যমে)
  6. সরল পথের প্রেক্ষাপটে-
    1. আল-ফাতিহা – সরল পথের পথপ্রদর্শনা চাই
    2. আন-নাস – শয়তান থেকে আশ্রয় চাই যারা প্রতিনিয়ত আমাদেরকে সরল পথ থেকে বের করার জন্য অবিরাম সংগ্রাম করে যাচ্ছে।
  7. পরিশেষে, দুইটি সূরা দ্বারা কুরআনের প্রথম এবং শেষ অংশে মানবজাতির জন্য দুআ উল্লেখিত হয়েছে

 

আন-নাস এবং আল-ফালাক  মিল

  1. হিংসা-এর প্রেক্ষাপটে-
    1. আল-ফালাক – শেষে হিংসুক থেকে আশ্রয় চাওয়া হয়।
    2. আন-নাস – হিংসুক শয়তান থেকে আশ্রয় চাওয়া হয়
  2. ভেতরে ও বাহিরে-
    1. আল-ফালাক – বাহিরের অমঙ্গল থেকে সুরক্ষা – যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে
    2. আন-নাস – আমাদের ভিতরের অমঙ্গল থেকে সুরক্ষা – যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের আওতাধীন। উল্লেখ্য যে, ইবলিস (কেয়ামতের দিন) আমাদের পাপের জন্য শুধুই আমাদেরকে দায়ী করবে কারণ সে শুধুই (প্রলোভনের দ্বারা) খারাপ কাজে আমাদেরকে আমন্ত্রিত করেছে আর আমরা নিজেরাই তা করে চলেছি।
  3. আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) কাছে আশ্রয় চাওয়া-
    1. আল-ফালাক – পার্থিব সুরক্ষা চাওয়া হয়েছে তাই আল্লাহকে একবার ডাকা হয়
    2. আন-নাস – আমাদের দ্বীন / ঈমান এর সুরক্ষা চাওয়া হয়েছে তাই আল্লাহকে তিনবার ডাকা হয়েছে।

One comment

Comments are closed.