সূরা ইখলাস দিয়ে শুরু করলে:
সূরা ইখলাস আসলে তাওহীদ নিয়ে আলোচনা করে। এই সূরাটি আমাদের সৃষ্টিকর্তাকে বুঝতে সাহায্য করে এবং তার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়।। বর্ণনায় আছে, এই সূরাটি তখন অবতীর্ণ হয়েছিল যখন আমাদের নবী মুহাম্মদ (সাঃ) কে আমাদের সৃষ্টিকর্তার বৈশিষ্ট সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। এই সূরাটিতে সৃষ্টিকর্তার চারটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে:
- বলুন, তিনি আল্লাহ, এক (শুধুই একক)
- তিনি অমুখাপেক্ষী (মানে তিনি কারো উপরেই নির্ভরশীল নয়, এবং সবাই ও সবকিছুই তার সাহায্যের উপর নির্ভরশীল)
- তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাকে জন্ম দেয়নি (অর্থাৎ তার কোনো সন্তান নেই আর সে কারো সন্তানও নয়)
- এবং তার সমতুল্য আর কেউ নেই (মর্যাদাক্রমে তার সমকক্ষ কেউ হতে পারে না, তিনি সবকিছুর উর্ধে – তিনি ত্রূটি মুক্ত)।
এবার সূরা কাফিরুন দৃষ্টিপাত করলে,
সূরা কাফিরুন আসলে শিরক থেকে আমাদের রক্ষা করে। এই ব্যাপারটি বুঝতে হলে আমাদেরকে কুরআন নাযিল হওয়ার পূর্বের আদি মক্কার পরিস্থিতি বুঝতে হবে। তখনকার আরব বাসীরা আল্লাহকেই উপাসনা করত, তবে তারা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার পাশা-পাশি মূর্তি পূজাও করত।
সূরা আয-যুখরুফ আয়াত ৮৭-এ বলা হয়েছে যে: “যদি আপনি তাদেরকে (অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের পূর্বের মক্কা বাসীদের) জিজ্ঞাসা করেন, কে তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তবে তারা অবশ্যই বলতো, আল্লাহ।”
সূরা আনকাবুত আয়াত ৬১ তে উল্লেখ করা আছে “যদি সেই মূর্তি পূজাকারিদেরকে জিজ্ঞেস হতো, কে নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডল সৃষ্টি করেছে? কে চন্দ্র ও সূর্যকে তাদের দ্বায়ীত্বে নিয়োজিত করেছে? তখন তারা বলতো আল্লাহ।”
সুরা মুমিনুন: আয়াত ৮৪-৮৯ এ বর্ণিত আছে যে যখন তাদের জিজ্ঞাসা করা হতো “পৃথিবী এবং এর মধ্যে যা কিছু আছে, তাদের মালিক কে? সপ্তাকাশ ও মহা-আরশের মালিক কে? তখন তারা উত্তরে বলতো: “সবই আল্লাহর।”
তারপর যখন তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হতো, তাহলে কেন তোমরা এসব মিথ্যা দেবতাদের উপাসনা কর? তারা জবাবে বলতো যে, তারা আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য এবং তাদের সুপারিশকারী হিসেবে কাজে লাগানোর জন্য তাদেরকে উপাসনা করতো। এখনও, এমন মানুষ আছে, যারা নিজেকে এতটাই পাপী মনে করে যে তারা আল্লাহর কাছে কিছু চাইতে লজ্জা বোধ করে, তাই তারা আল্লাহর কাছে তাদের সুপারিশকারী হিসেবে অন্য আরেকজন হুজুর বা পবিত্র ব্যক্তি, অলি-আউলিয়ার মতো আরেকজন মানুষ বেছে নেয় – যা আসলে ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গিতে উচিত নয়।
আয-যুমার আয়াত ৩-এ বর্ণিত, যারা আল্লাহ ব্যতীত অপরকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করে রেখেছিলো এবং বলতো যে, আমরা তাদের এবাদত এ জন্যেই করি, যেন তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়। তারা আসলে সৎপথে পরিচালিত ছিল না।
সূরা ইউনূস আয়াত ১৮-এ উল্লেখিত হয়েছে, তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন বস্তুর উপাসনা করতো, যা না তাদের কোন লাভ বা ক্ষতি করতে পারতো না, তারা তখন বলতো, এরা তো আল্লাহর কাছে আমাদের সুপারিশকারী। কিন্তু, তারা যেসবের মূর্তি বা দেব দেবীদেরকে নিয়ে শিরকে লিপ্ত আছে, সে সমস্ত কিছুর অংশীদারিত্বের থেকে আল্লাহ সুবহানু ওয়াতালা অনেক পবিত্র ও মহান।
সুতরাং, মুহাম্মদ (সাঃ) তাদেরকে সম্পূর্ণ নতুন কোনো ইশ্বরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেননি। তারা তখনও আল্লাহকে সমস্ত ঈশ্বরের প্রধান হিসেবেই বিশ্বাস করতো। তিনি শুধু বাড়তি এতটুকুই বলেছিলেন যে, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে উপাসনা বা ইবাদত করো না।
যদি কেউ আল্লাহকে উপাসনা করার দাবি করে, আর তার সাথে অন্য কোন সত্তাকেও সেই ইবাদতের পর্যায়ে উঠিয়ে ফেলে, যা উপাসনা হিসাবে বিবেচিত হয়, তাহলে সে ইসলামিক দৃষ্টিতে সবচাইতে বড় অপরাধ অর্থাৎ শিরক করে ফেলে। সূরা কাফিরুনে একটি জোরালো বার্তা রাখা হয়েছে যে, যদি কেউ আল্লাহকে ইবাদত করে আর তার সেই উপাসনার মধ্যে শিরক ঢুকে পরে, তাহলে তার উপাসনা আর আল্লাহের জন্য গণ্য করা হয় না। যদি সেই ব্যক্তিটি আল্লাহর নাম নিয়েও ইবাদত করে তবুও সেই ইবাদত আমাদের সত্যিকার সৃষ্টিকর্তার ইবাদত হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয় না। আমাদেরকে অবশ্যই তৌহিদের পবিত্রতার সাথে শুধুমাত্র এক আল্লাহ সুবহানু ওয়াতায়ালার উপাসনা করতে হবে।
এই সব কিছু মাথায় নিয়ে, এই দুইটি সূরার সাহায্যে, সৃষ্টিকর্তার বৈশিষ্টের সম্পূর্ণ ধারণাটি নিখুঁতভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব এবং আমাদের কাছে তৌহিদের গুরুত্ব এবং শিরকের বিপদ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই দুইটি সূরাকে একত্রে ইখলাসাইন বলা হয়, যা আমাদের ধর্ম বিশ্বাসকে বিশুদ্ধ করে।
এইবার সূরা ফালাক নিয়ে আলোচনা করে দেখি,
এই সূরা আমাদেরকে সব রকমের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি থেকে রক্ষা করে, যা আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে। এই সূরাটির সাহায্যে আমরা পৃথিবীর সব ধরণের ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে আল্লাহ সুবহানু ওয়াতালার আশ্রয় প্রার্থনা করি।
আর আমরা যদি সূরা নাসের অর্থে একটু পর্যালোচনা করি
এই সূরাটির সাহায্যে আমরা শয়তানের ওয়াস-ওয়াসার ক্ষতি থেকে আল্লাহ সুবহানু ওয়াতালার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি। এই রকমের ফিসফিস করে কুমন্ত্রণা আমাদের আত্মিক ক্ষতি করতে পারে। আত্মিক ক্ষতি প্রাথমিকভাবে আমাদের পরকালকে প্রভাবিত করে আর আমরা যদি আত্মিক ক্ষতি থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারি, তাহলে আমরা জাহান্নামের আগুন থেকেও নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারবো ইনশা আল্লাহ।
সুতরাং, এই দুইটি সূরা, যা একসাথে মুআউবিধাতাইন বলা হয়, আমাদেকে শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক ক্ষতি থেকে সুরক্ষিত রাখে এবং এই ভাবেই আমাদেরকে জীবন ও পরকালে আমাদেরকে রক্ষা করে।
সবশেষে, আসুন এইবার দেখি কিভাবে এই সব সূরাগুলি সূরা ফাতিহার সাথে সম্পর্কিত,
সূরা ফাতিহা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার প্রশংসা দিয়ে শুরু হয়, তারপর সূরাটির কেন্দ্রীয় বা মূল অংশে এসে আমরা বলি যে আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে উপাসনা করি এবং তাঁর কাছে সাহায্য চাই। সাহায্যটি কি? ঠিক পরের আয়াতেই আমরা আল্লাহর কাছে দুআ করি যেন তিনি আমাদেরকে সহজ-সরল পথের পথনির্দেশনা দেন। আল্লাহ সুবহানু ওয়াতালার সাহায্য ও হেদায়েত আমাদের অত্যন্ত প্রয়োজন। তার সাহায্য ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না এবং নিজেদেরকে রক্ষাও করতে পারি না। আমাদেরকে যেহেতু স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দেওয়া হয়েছে, তাই আমাদের তাঁর পথনির্দেশনা প্রয়োজন – সঠিকভাবে এই জীবনটি পরিচালনা করার জন্য। বিচারদিনের ন্যায়বিচারে নিজেদেরকে শাস্তি থেকে রক্ষা করে পরকালের সর্বোত্তম পুরস্কার অর্জন করার জন্যও আমাদের সঠিক পথনির্দেশনা প্রয়োজন। এবার আসুন দেখি কিভাবে এই চারটি কুল বিশিষ্ট সূরাগুলো, সূরা আল ফাতিহার সাথে কেন্দ্রীয়অর্থে সম্পর্কিত।
- তৌহিদ ও ইখলাস সঠিকভাবে বুঝার জন্য আমাদের পথনির্দেশনা প্রয়োজন
- শিরক থেকে বাঁচতে হলেও আমাদের সঠিক পথনির্দেশনা প্রয়োজন
- এই জীবনের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি থেকে সুরক্ষার জন্য আমাদের আল্লাহর সাহায্যের প্রয়োজন
- এবং সবশেষে শয়তানের ফিস ফিস করে কুমন্ত্রণার ক্ষতি ও পথভ্রষ্টতা থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য আমাদের আল্লাহের সাহায্য ও পথনির্দেশনা প্রয়োজন হয়, যা আমাদের আখেরাতকে ধ্বংস করে দিতে পারে – আর এইভাবেই সূরা ফাতিহার দুআটি আমাদের এই সবকিছুর বিষয়ে খেয়াল রাখে ও আমাদেরকে এসব বিষয়ে সাহায্য করে।