একটি ছোট দুআ দিয়ে শুরু
সকল প্রশংসা এক আল্লাহ(সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) যিনি একক, সর্বোচ্চ স্থানের অধিকারী এবং পরম দয়ালু। আমরা সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ (সাঃ) কে অভিবাদন জানাই এবং প্রার্থনা করি যে তার উপর আল্লাহ(সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) রহমত বর্ষিত হোক, তার সাথে সাথে তার সমগ্র পরিবার, সাহাবাগণ এবং তার প্রত্যেকেটি অননুসারীর উপর রহমত বর্ষিত হোক। আমীন
তাওহীদ-এর সূচনা
তাওহীদ-এর অর্থ
তাওহীদ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো একত্ববাদ। সহজ কথায়, ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহকে একক ও অদ্বিতীয় রূপে মেনে নেওয়ার নাম তাওহীদ।
সৃষ্টিকর্তা এক – এই ব্যাপারটি হলো ইসলামের মূলনীতি বা মূল মতবাদ। এই শব্দটি আরবী ভাষার ক্রিয়াপদ “ওয়াহাদা” থেকে এসেছে যার অর্থ মিলিত বা দলবদ্ধ করা। যখন তাওহীদ বিষয়টি আল্লাহ(সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, তখন তা বোঝায়:
- আল্লাহ(সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) এক;
- তার কোনো অংশীদার নাই;
- তাঁর সত্তা বা বৈশিষ্ট্যাগত দিক থেকে, অন্য কেউ তার মতো হতে পারে না; এবং
- শুধুমাত্র তিনি সকল এবাদতের প্রাপ্য বা অধিকারী।
আল্লাহ(সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করলে নিকৃষ্টতম অপরাধ সংগঠন হয়, যার নাম হলো শিরক তাই আমাদেরকে এই বিষয়টিতে অত্যান্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
তাওহীদ ইসলামের মূল ভিত্তি যার উপর অন্যান্য সব স্তম্ভ ও মূলনীতিগুলো নির্ভর করে। তাওহীদ হলো ইসলামের মূলসূত্র যা সঠিকভাবে যে পবিত্র বাক্যে (আমাদের কালিমায়) উচ্চারিত হয় সেটি হলো: “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” (অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই)। এর আসল অর্থ হলো সত্যিকার ইলাহ – বা ইবাদতের অধিকারী এক এবং অদ্বিতীয়। এই সহজ সূত্রটি আমাদের ঈমান (প্রকৃত স্রষ্টায় সত্যিকার বিশ্বাস) ও কুফুর (অবিশ্বাস বা অস্বীকার) এর মাঝে পার্থক্যকারী রেখা সৃষ্টি করে।
আল্লাহ কি সব জায়গায়?
আল্লাহ সবজায়গায় আছেন ও সবকিছুতে বিরাজমান, এই ধারণাটি সর্বজন অনুমোদিত ইসলামে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এই ভ্রান্ত ধারণাটি মানুষকে এক আল্লাহর উপাসনা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারে, এটি তাদের মধ্যে সৃষ্ট জিনিষকে উপাসনা/পূজা করার যৌক্তিকতা গড়ে তুলতে পারে। একজন খুব সহজেই চিন্তা করতে পারে যে সৃষ্টিকর্তা তো সবজায়গায় আছে তাহলে তো এই মূর্তির মধ্যেও আছে, তাহলে এই মূর্তিকে সেজদা করতে সমস্যা কি? আমি তো আমার সৃষ্টিকর্তাকেই সেজদা করছি।
কুরআনের আয়াত থেকে বিশ্লেষণ
নীচের আয়াতসমূহ থেকে আল্লাহ(সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) সৃষ্টিকূলের সর্বোচ্চ স্থানে অবস্থানের সম্পর্কে ধারণা দেয়:
তিনি পরম দয়াময়, আরশে সমাসীন হয়েছেন। {সূরা ত্বা-হা: আয়াত ৫}
আল্লাহ যিনি নভোমন্ডল, ভুমন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনি আরশে বিরাজমান হয়েছেন। …{সূরা-আস-সাজদাহ: আয়াত ৪}
নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। তিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরশের উপর অধিষ্টিত হয়েছেন।… {সূরা আল আরাফ : আয়াত ৫৪}
যিনি যথাবিধি আকাশরাজি ও ভূ-মন্ডল সৃষ্টি করেছেন। তারা যাকে শরীক করে তিনি তার বহু উর্ধ্বে। {সূরা আন নাল: আয়াত ৩}
তারা তাদের উপর পরাক্রমশালী তাদের পালনকর্তাকে ভয় করে এবং তারা যা আদেশ পায়, তা করে {সূরা আন নাহল: আয়াত ৫০}
নিচের আয়াতটি, আরশের উপর তার অবস্থান উল্লেখ করেছে আবার একই সাথে তিনি যে তাঁর দৃষ্টি ও জ্ঞানের মাধ্যমে আমাদের সাথেই সার্বক্ষণিক আছেন সেই কথাও আমাদেরকে জানিয়েছে।
তিনি নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডল সৃষ্টি করেছেন ছয়দিনে, অতঃপর আরশের উপর সমাসীন হয়েছেন। তিনি জানেন যা ভূমিতে প্রবেশ করে ও যা ভূমি থেকে নির্গত হয় এবং যা আকাশ থেকে বর্ষিত হয় ও যা আকাশে উত্থিত হয়। তিনি তোমাদের সাথে আছেন তোমরা যেখানেই থাক। তোমরা যা কর, আল্লাহ তা দেখেন। {সূরা আল হাদীদ: আয়াত ৪}
নিম্নলিখিত আয়াতগুলোতেও একইভাবে আমাদের সাথে তাঁর উপস্থিতির কথা উল্লেখিত হয়েছে। যখনি তিঁনি আমাদের নৈকট্যের কথা উল্লেখ করেছেন তার সাথে সাথেই তিঁনি তার ঐশ্বরিক জ্ঞান, দৃষ্টি, বা আমাদের দু-কাঁধের ফেরেস্তাদের কথা উল্লেখ করেছেন।
আল্লাহ বললেনঃ তোমরা ভয় করো না, আমি তোমাদের সাথে আছি, আমি শুনি ও দেখি। {সূরা নিসা: আয়াত ৪৬}
আপনি কি ভেবে দেখেননি যে, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, আল্লাহ তা জানেন। তিন ব্যক্তির এমন কোন পরামর্শ হয় না যাতে তিনি চতুর্থ না থাকেন এবং পাঁচ জনেরও হয় না, যাতে তিনি ষষ্ঠ না থাকেন তারা এতদপেক্ষা কম হোক বা বেশী হোক তারা যেখানেই থাকুক না কেন তিনি তাদের সাথে আছেন, তারা যা করে, তিনি কেয়ামতের দিন তা তাদেরকে জানিয়ে দিবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত।
{সূরা আল-মুজাদালা: আয়াত ৭}
আল-কাসিমী বলেছেন, “এই আয়াতটিতে বুঝানো হয়েছে যে আল্লাহ(সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) তাঁর আরশের উপরে আছেন কিন্তু তার দৃষ্টি ও জ্ঞানে তিঁনি সবজায়গায় আছে।
আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি এবং তার মন নিভৃতে যে কুচিন্তা করে, সে সম্বন্ধেও আমি অবগত আছি। আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমনী থেকেও অধিক নিকটবর্তী। যখন দুই ফেরেশতা ডানে ও বামে বসে তার আমল গ্রহণ করে। {সূরা কাফ: আয়াত ১৬-১৭}
শেষ আয়াতটিকে অধিকাংশ মুফাস্সিরীন (ব্যাখ্যাকারীগণ) এভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, তিনি তাঁর ফেরেস্তাদের দ্বারা আমাদের কাছে থাকেন – এই ফেরেস্তাদের কাজ হলো মানুষের কার্যকলাপ রেকর্ড করা বা লিপিবদ্ধ রাখা।
উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় হলো, যেইসব আয়াতেই আল্লাহ(সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেন যে তিঁনি আমাদের কাছেই আছেন, এই রকম প্রত্যেকটি আয়াতের পর পরই তিনি উল্লেখ করেছেন যে, তিঁনি জানেন, দেখেন বা শুনেন অথবা তাঁর ফেরেস্তারা লিখছেন – যা দিয়ে বোঝা যায় যে তিঁনি তাঁর দৃষ্টি ও জ্ঞানের মাধ্যমে আমাদের নিকটে আছেন, এভাবেই এই ভূল ধারণাটি এড়ানো হয়েছে যে তিঁনি সব জায়গায় আছেন।
বাস্তবিক বা যৌক্তিক বিশ্লেষণ
সবে মিরাজ এর যাত্রা
আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা), তাঁর সৃষ্টি থেকে আলাদা, তাঁর আরশের উপরে আছেন। আমরা সবাই জানি যে, মিরাজের রাত্রিতে মুহাম্মাদ(সাঃ) মক্কা থেকে জেরুজালেমে ভ্রমণ করেছিলেন এবং সেখানে থেকে তাকে আল্লাহর নিকট পৌঁছানোর জন্য সাত আসমান / সপ্তাকাশ অতিক্রম করে উপরে যেতে হয়েছিল – যেখান থেকে তিনি আমাদের ৫ রাকাত ফরজ নামাজের আদেশ নিয়ে এসেছিলেন। সুতরাং, এখানে সহজভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে আল্লাহ(সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) তার আরশের উপরেই আছেন সে জন্যই তার কাছে পৌঁছানোর জন্য সাত আসমান অতিক্রম করতে হয়েছিল।
আমরা সেজেদায় গিয়ে যা বলি
আরেকটি শক্ত যুক্তি হলো যে, যখন আমরা আল্লাহ(সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) নিকট আমাদের সেজদায় যাই তখন আমরা বলি – “সুবহানা রব্বিয়াল আ’লা” যার অর্থ “আমার সর্বোচ্চ প্রভুর প্রশংসা করছি”। আমরা প্রতিনিয়ত তাঁর অবস্থান ঘোষণা করি যখন আমরা আমাদের সেজদায় (নিজেদের সবচাইতে নিম্নতম অবস্থায়) থাকি।
এই সমস্ত বিষয়গুলো মহান আরশের উপরে, তাঁর সৃষ্টি থেকে আলাদা, তাঁর যথাযোগ্য অবস্থান প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট হওয়া উচিত।
তাওহীদ ব্যাপারটি বোঝার গুরুত্ব
শয়তান হলো মানবজাতির চিরন্তন ও প্রধান শত্রু, যে প্রতিজ্ঞা করেছে যে, মানব জাতিকে আল্লাহর নির্দেশিত সরল পথ থেকে বিচ্যুত করতে সে আমরণ চেষ্টা চালিয়ে যাবে – তাই আমাদের নিজেদেরকে রক্ষা করতে হবে। কুরআনুল করিম ও সহীহ হাদিস থেকে শুরু করে, নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে আমাদেরকে আরো বেশি বেশি জ্ঞান অর্জন করতে হবে এবং নিজস্ব কল্পনার ওপর ভিত্তি করে অনুমান করা যথাসম্ভব এড়াতে হবে, কারণ আমাদের কল্পনাতে শয়তানের বিশেষ প্রভাব থাকে।
একদিন, নবী মুহাম্মদ(সাঃ) তার সাহাবীগণদের সাথে বসে ছিলেন। তিনি মাটিতে একটি সরল রেখা টানলেন তারপর তার পাশদিয়ে অনেকগুলো শাখা রেখা টানলেন। তিনি শাখা রেখাগুলো দেখিয়ে বললেন এগুলো হলো বিভিন্ন ভ্রান্ত পথের উদাহরণ যেদিকে শয়তান মানুষদেরকে আমন্ত্রণ জানায়। তারপর তিনি সরল রেখাটি দেখিয়ে বললেন এটি হলো একমাত্র আল্লাহ(সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) পথ। সাহাবীগণ আরও ব্যাখ্যা চাইলে তিনি নিম্নলিখিত আয়াত পাঠ করেছিলেন:
“তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। নিশ্চিত এটি আমার সরল পথ। অতএব, এ পথে চল এবং অন্যান্য পথে চলো না। তা হলে সেসব পথ তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে। তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা সংযত হও।“{সূরা আল-আনাম: আয়াত ১৫৩}
অতএব, তাওহীদ ব্যাপারটিকে রসূল (সাঃ) আমাদেরকে যেভাবে শিখিয়েছেন এবং তার সাহাবীগণ যেভাবে অনুধাবন করেছিলেন এই ব্যাপারটিকে আমাদেরকে ঠিক সেভাবে বুঝতে হবে, নাহলে কেউ খুব সহজেই আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) পথ থেকে বিপথগামী হয়ে যেতে পারে। মনের মধ্যে ভুল ধারণা শুধু চারিপাশেই ছড়ায় না বরং পরবর্তী প্রজম্মতেও বয়ে নিয়ে গিয়ে আমাদের ধর্মের মূল নীতি ধ্বংস করে ফেলে, তাই আমাদেরকে এই ব্যাপারটিতে অনেক সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
তাওহীদের শ্রেণীবিন্যাস
তাওহীদ সাধারণত নিম্নোক্ত ৩টি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়:
- তাওহীদ আর-রুবূবীয়াহ (আক্ষরিক অর্থে “আল্লাহর কতৃত্বে একতা বজায় রাখা”) অর্থাৎ, এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকা যে আল্লাহ এক এবং তাঁর কতৃত্ব ও ক্ষমতায় কোনো অংশীদার নেই।
- তাওহীদ আল-আসমা ওয়াছ-সিফাত (আক্ষরিক অর্থে “আল্লাহর নাম ও গুণাবলীতে একতা বজায় রাখা”) অর্থাৎ, এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকা যে আল্লাহের প্রত্যেকটি নাম ও গুণাবলী হলো সম্পূর্ণরূপে অতুলনীয় এবং অদ্বিতীয়।
- তাওহীদ আল-ইবাদাহ (আক্ষরিক অর্থে “আল্লাহর এবাদত/প্রার্থনায় একতা বজায় রাখা”) অর্থাৎ, এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকা যে শুধুমাত্র অল্লাহ্ই সকল এবাদতের একমাত্র অধিকারী।
একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
রসূল(সাঃ) বা তার সাহাবীগণ তাওহীদ এর শ্রেণীবিন্যাস করেন নি, কারণ তৎকালীন সময়ে এমনটির দরকার ছিল না। তবে বর্তমান সময়ে, উম্মতের ধর্মীয় জ্ঞানের ও ঐক্যবদ্ধের অভাবের জন্য, এই ব্যাখ্যাগুলো সময়ের সাথে সাথে আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে ।
ইসলাম ধীরে ধীরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে যেমন মিশর, রোম, পারস্য, ভারত ইত্যাদি, এসব অঞ্চলে এসে দুর্ভাগ্যবশত এই সব এলাকার সংস্কৃতির সাথে মিশে গিয়ে ধর্মটি প্রভাবিত হয়েছে। আবার কিছু মানুষ বাহ্যিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করলেও গোপনে এর ছায়াতলে থেকে, ঈমানের প্রথম স্তম্ভ, তাওহীদের মূল ধারণাটি বিকৃত করে – এই ধর্মটি ধ্বংস করার চেষ্টা চালিয়েছে। এইজন্য ইসলামিক স্কলারদের কাছে এই ব্যাপারটি অনেক জরুরী হয়ে পড়েছে, যেন তারা যথাযথ যুক্তি দিয়ে এই সব ভূল ধারণাগুলো নির্মূল করে – মুসলমানদের কাছে তাওহীদের সঠিক ধারনাটি উপস্থাপন করতে পারে।
এবার তাওহীদের এই তিনটি শ্রেণী সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করি। এই তিনটি শ্রেণী আসলে একে ওপরের সাথে সম্পর্কিত, কিন্তু বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যে আমরা এগুলোকে আলাদাভাবে বিচার করবো। উদাহরণস্বরূপ, আমরা যখন মানুষের শরীর নিয়ে গবেষণা করি, তখন আমাদের কঙ্কাল, স্নায়ুতন্ত্র, রক্ত সঞ্চালনতন্ত্র, খাদ্য পরিপাকতন্ত্র, ইত্যাদি আলাদাভাবে বিবেচনা করতে হয়, কিন্তু এগুলো আসলে একসাথেই পুরো দেহটি গঠন করে। একইভাবে, এই শ্রেণীগুলো আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করা হলেও এগুলো একসাথে তাওহীদের মূল বিশ্বাসটি সম্পূর্ণরূপে গঠন করে।
তাওহীদ আর-রুবূবীয়াহ (আল্লাহর কতৃত্ব ও ক্ষমতায় একত্ববাদ)
এই শ্রেণীটির মৌলিক ধারণা হলো এই যে, আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) এক এবং তিঁনি সবকিছু শুন্য থেকে সৃষ্টি করেছেন। তিঁনি কোনো রকম সহায়তা ছাড়াই সবকিছু প্রতিপালন ও নিয়ন্ত্রণ করেন। তিঁনি সমগ্র বিশ্বজগত এবং এর সমস্ত বাসিন্দাদের একমাত্র প্রভু এবং তাঁর সার্বভৌমত্বে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই।
আরবি শব্দ রুবূবীয়াহ এই স্রষ্টা-প্রতিপালক গুনের বর্ণনা দেয়, যার উৎপত্তি হয়েছে মূল শব্দ ‘রব’(প্রভু) থেকে। আমরা সূরা ফাতেহাতে বলি:
আলহামদু-লিল্লাহি-রাব্বিল-আলামীন; এখানে ‘রব’ শব্দের অর্থ যিনি সমগ্র অস্তিত্বের প্রতিটি জিনিস সৃষ্টি করেন, প্রতিপালন করেন ও টিকিয়ে/বাঁচিয়ে রাখেন।
কুরআনের অনেকগুলো আয়াত রয়েছে যেখানে রুবূবীয়াহ ধারণাটির বর্ণনা খুঁজে পাওয়া যায়, উদাহরণস্বরূপ, আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেন:
আল্লাহ সর্বকিছুর স্রষ্টা এবং তিনি সবকিছুর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। {সূরা আয-যুমার: আয়াত ৬২}
আল্লাহর নির্দেশ ছাড়া কোন বিপদ আসে না এবং যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করে, তিনি তার অন্তরকে সৎপথ প্রদর্শন করেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সম্যক পরিজ্ঞাত।{সূরা আত-তাগাবুন: আয়াত ১১}
সুতরাং, আল্লাহ(সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা এবং নিয়ন্ত্রক। তাঁর অনুমতি ছাড়া অস্তিত্বের কোনো কিছুই ঘটেনা। এই বাস্তবতার স্বীকৃতিস্বরূপ নবী মুহাম্মদ (সাঃ) প্রায়ই এই বিস্ময়সূচক বাক্যটি পুনরাবৃত্তি করতেন, “লা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ” (অর্থাৎ আল্লাহর [সাহায্য/সমর্থন] ব্যতীত কোনো শক্তি বা নড়চড়/গতিবিধি নেই)।
উপরন্তু, নবী(সাঃ) তার একটি হাদিসে বর্ণনা করেছেন যে:
“…আর জেনে রাখো, যদি সকল উম্মাতও তোমার কোন উপকারের উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হয় তাহলে ততটুকু উপকারই করতে পারবে, যতটুকু আল্লাহ তা‘আলা তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। অপরদিকে যদি সকল উম্মাত তোমার কোন ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে একতাবদ্ধ হয়, তাহলে ততটুকু ক্ষতিই করতে সক্ষম হবে, যতটুকু আল্লাহ তা‘আলা তোমার তাক্বদিরে লিখে রেখেছেন। কলম তুলে নেয়া হয়েছে এবং লিখিত কাগজসমূহও শুকিয়ে গেছে। {জামে’ আত-তিরমিজি, হাদীস নং: ২৫১৬}
খারাপের উৎপত্তি কিভাবে হয়?
কিন্তু, এই ধারণাটি অদ্ভুত কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন করে:
- তাহলে দুর্ঘটনা বা অকল্যাণ কোথায় থেকে উৎপত্তি হয়?
- এসবের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ কে?
- এসবও কি সেই একই প্রভু/ঈশ্বর সৃষ্টি ও নিয়ন্ত্রণ করেন?
বেশিরভাগ নাস্তিক ও অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরা এমনকি অনেক মুসলিমরাও এই ব্যাপারটিতে ভুল ধারণা পোষণ করে। এই ধারণাটির সঠিক ব্যাখ্যা না দিতে পারলে যে কেউ আল্লাহ(সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) ন্যায্যতা/ন্যায়পরায়ণতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে; উদাহরণস্বরূপ:
- কেন আল্লাহ আমার সাথে এমন করলেন?
- আমি কি এগুলোর প্রাপ্য?
- কীভাবে আল্লাহ আমার সাথে এরকম অন্যায় করতে পারলো? – নাউজুবিললাহ
এমনকি মানুষ আল্লাহ(সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) অস্তিত্ব নিয়েও সন্দেহ করা শুরু করে দিতে পারে। কারণ যখন তাদের উপর কোনো অবিচার করা হয় বা কোনো খারাপ পরিস্থিতি আসে তখন তারা আল্লাহ কে এসব পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারকারী বা সাহায্যকারী হিসেবে খুঁজে পায় না। এসব প্রশ্নের উত্তর এই আর্টিক্যালের নিচের দিকে আলোচনা করা হয়েছে।
অপদেবতা/শয়তানকে একটি আলাদা ঈশ্বর রূপে বিবেচনা করা
জরইস্ত্রিয়ানিজিম ধর্ম (ইরানের অগ্নিপূজা উপাসকদের একটি ধর্ম) একটি উদাহরণ যেখানে, এর অনুসারীরা এই অবস্থার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ২টি পৃথক দেবতা বানিয়ে ফেলেছে, একটি হলে ভালো দেবতা আরেকটি হলো খারাপ দেবতা। তাদের মূল ঈশ্বরের নাম হলো আহুরা মাজদা আর শয়তান/খারাপ দেবতার নাম হলো আংরা মাইনু। ভালো ঈশ্বরের প্রতীক হিসেবে আগুন এবং খারাপ দেবতার প্রতীক হিসেবে অন্ধকারকে বিবেচনা করা হয়, যদিও শেষ পর্যন্ত ভালো ঈশ্বরটি বিজয়ী হবে। কিন্তু এইভাবে শয়তানকে খোদার কাছাকাছি বা সমকক্ষ পর্যায়ে উত্থাপন করা হয়ে যায়, যেখানে শয়তানকে ঈশ্বরের অনুমতি ছাড়াই এবং নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে খারাপ জিনিস সৃষ্টি করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
এই ধারণাটির মধ্যে একটি মারাত্মক সমস্যা রয়েছে। শয়তান যদি আলাদা দেবতা হয় তাহলে ঈশ্বর / ভালো দেবতার উপর নির্ভর করা কঠিন হয়ে যায়। কারণ, (তাদের ভাষ্যমতে) খারাপ পরিস্থিতিগুলোর উৎপত্তি তাহলে ভালো ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকবে, আর এই অবস্থায় কোনো মানুষ যদি নিজেদের ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে চাইবে বা কারো ক্ষতি করতে চাইবে, তখন তাদের মধ্যে শয়তান পূজা করার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। উপরন্তু, শয়তানের উপাসক হওয়ার জন্য তাদের নিজেদের জীবনধারা সংশোধন করার কোনো প্রয়োজনও হবে না।
আল্লাহ প্রত্যেকটি জিনিস বা ঘটনার সর্টিষ্টকর্তা এবং পূর্ণ নিয়ন্ত্রক
আসুন, এবার অধিকাংশ মুসলিম স্কলার বা উলামাদের মতে এই ধারণাটি নিয়ে আরও একটু বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করে দেখি।
আল্লাহ(সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) উল্লেখ করেছেন যে, তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, যা স্বাভাবিক ভাবেই বুঝায় যে অস্তিত্বের প্রত্যেকটি জিনিসই তাঁর কাছ থেকে উৎপত্তি ঘটেছে। সুতরাং, সকল সৌভাগ্য এবং সকল দুর্ভাগ্যই (আমাদের ধারণামতে) আসলে আল্লাহ(সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) পক্ষ থেকেই আসে।
আমরা যে কোনো জিনিস বা ঘটনা-কে অকল্যাণকর মনে করলেও, প্রকৃতপক্ষে তা সম্পূর্ণরূপে খারাপ হয় না। প্রতিটি সৃষ্টিরই ভালো দিক আছে। আমরা যদি কুরআন ও সুন্নত আঙ্গিকে দেখি, কুরআনে আল্লাহ সুবহানু ওয়াতালা নিজেকেই এমন সৃষ্টির সৃষ্টিকর্তা হিসেবে দাবি করেছেন যা আমাদের ক্ষতিসাধন করতে পারে। যেমনটি সুরাহ ফালাক এর মধ্যে তিনি বলেছেন:
কুল আউযু বিরাব্বিল ফালাক, মিন শাররিমা খলাক।
বলুন, আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি প্রভাতের পালনকর্তার, তিনি যা সৃষ্টি করেছেন, তার অনিষ্ট থেকে {সূরা ফালাক, আয়াত ২}
এই জগৎ এমনভাবেই কাজ করে যে, কিছু জিনিস আপাতদৃষ্টিতে অশুভ বা কিছু মানুষের জন্য ক্ষতিকারক মনে হলেও, এগুলো থেকে ভালো কিছুর উৎপত্তি ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, ধরুন একজন একটি ডাক্তার এর কাছে গেলো এবং সেই ডাক্তারটি তাকে চিকিৎসা হিসেবে একটি ইনজেকশন দিতে বললো। আপনি যদি শুধু ইনজেকশনের কথা চিন্তা করেন, তাহলে এটা খারাপ মনে হবে, তাই না? যদি হটাৎ করে কেউ এসে আপনাকে বলে “আমি আপনার হাতে একটি সুই ফুটাতে চাচ্ছি” আপনার প্রতিক্রিয়া কি হবে? আপনি বলবেন “না ধন্যবাদ! আমি মর্ষকামী না (যারা সুই ফুটিয়ে আনন্দ পায়)”। কিন্তু ডাক্তার ও রুগীর ক্ষেত্রে এই ইনজেকশন এর ভিতর একটি ভালো উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে – যা হলো এই রোগের চিকিৎসা। প্রতিটি দুর্ভাগ্য সবর ও ধৈর্য্যের সাথে পার করার মধ্যে পুরস্কার হিসেবে জান্নাত পাওয়ার আশা থাকে।
আদম এবং ইবলীসের গল্প থেকে শিক্ষা
আল্লাহ সুবহানু ওয়াতালা আদম আঃ সাঃ ও ইবলীস দুই জনেরই সৃষ্টিকর্তা। এই ঘটনাটি থেকে খুবই সাধারণভাবেই আমাদের মনে প্রশ্ন জগতে পারে: আল্লাহ কেন ইবলিসকে সৃষ্টি করলেন? আল্লাহ সুবহানু ওয়াতালা তো আগে থেকেই জানতেন যে ইবলিস আদম আঃ সাঃ এর সামনে সিজদাহ করতে অস্বীকার করবে এবং অবশেষে আদম আঃ সাঃ নিষিদ্ধ গাছ থেকে ফলটি খেয়ে ফেলবেন। সুতরাং, আল্লাহ সুবহানু ওয়াতালা শুধু আদম আঃ সাঃ কে সৃষ্টি করে, ইবলিসকে পুরো ঘটনা থেকে বাহিরে রাখলেই তো পারতেন। আসলে ইবলিসের সৃষ্টির পিছে একটি অতি মহান উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে, আসুন এই ব্যাপার নিয়ে আরো একটু বিস্তারিত আলোচনা করে দেখি।
উভয় আদম (আঃ) এবং ইবলীস ভুল করেছিল। একজন সেজদায় যেতে অস্বীকার করেছিল আরেকজন নিষিদ্ধ গাছ থেকে খেয়েছিলো। গুনাহ করলে বা আল্লাহের অবাধ্যতা করলেই কেউ কাফের হয়ে যায় না। যখন ইবলিসকে তার অবাধ্যতার কারণ জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তখন সে বলেছিলো “আমি তার থেকে শ্রেষ্ট, আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে মাটি দিয়ে”, তার যুক্তি মতে আল্লাহ সুবহানু ওয়াতালা তাকে নিকৃষ্টতর সৃষ্টিকে সেজদা দিতে আদেশ করে ভুল করেছেন – এবং ঠিক এই জায়গাতেই তার আসল কুফুরী প্রকাশ পেয়েছিলো। কিন্তু, আদম আঃ সাঃ এর ক্ষেত্রে, তিনি আল্লাহের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার পর, আল্লাহ সুবহানু ওয়াতালার কাছেই ফিরে তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন, যা কিনা অন্যতম একটি উপাসনা। সুতরাং, এইখানে খারাপের পিছনে অনেক উচ্চমর্যাদাপূর্ণ ভালো কিছু লুকোনো ছিল (খারাপ – ইবলিসের উপস্থিতি; ভালো – আদমের ক্ষমা প্রার্থনা)। ইবলিসের উপস্থিতি না থাকলে, আদম আঃ সাঃ এমন অবস্থায় পৌঁছাতেই পারতো না যেখানে থেকে তাকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয়েছিল।
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যে সত্তার হাতে আমার জীবন, আমি তাঁর কসম করে বলছি, তোমরা যদি পাপ না করতে তবে অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের নিশ্চিহ্ন করে এমন সম্প্রদায় বানাতেন যারা পাপ করে ক্ষমা চাইতো এবং তিনি তাদের মাফ করে দিতেন। {সহীহ মুসলিম; হাদিস নং ৬৮৫৮}। বরং, আল্লাহ সুবহানু ওয়াতালার ক্ষমা এর আশা ছেড়ে দেয়াকে কুফুরীর সাথে তুলনা করা হয়েছে সুরাহ ইউসুফ আয়াত ৮৭ এ, যেখানে আল্লাহ বলেছেন “নিশ্চয় আল্লাহর রহমত থেকে কাফের সম্প্রদায়, ব্যতীত অন্য কেউ নিরাশ হয় না।”
মুসা আঃ আর খিদির রাঃ এর গল্প থেকে শিক্ষা
মুসা আঃ আর খিদির রাঃ এর ঘটনায়, তারা দুইজনই একসাথে কিছু সময় কাটিয়েছিলো। মুসা আঃ সাঃ এর চোখে প্রাথমিক পর্যায়ে খিদির রাঃ এর কার্জকলাপগুলো খারাপ মনে হয়েছিল। কিন্তু তাদের যাত্রা শেষে যখন খিদির রাঃ তার সবগুলো কার্যকলাপের পেছনের উদ্দেশ্যগুলো ব্যখ্যা করেছিল তখন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন।
এই গল্পটি আসলে আমাদের শিখিয়েছিল যে খিদিরের সমস্ত কার্জকলাপগুলোর পিছনে বৃহত্তর ভাল উদ্দেশ্য লুকিয়ে ছিল। সুতরাং, অনেক কাজ বা ঘটনা আপাতদৃষ্টিতে খারাপ মনে হলেও এর পিছে ভালো কোনো কারণ বা উদ্দেশ্য থাকতেই পারে।
খারাপকে ছাড়া কখনই ভালাকে মূল্যায়ন করা যায় না
পৃথিবীর সকল খারাপ বা অশুভ জিনিসের পিছেই ভালো কিছু লুকিয়ে থাকে। আমরা কখনোই ভালো জিনিস বা কাজকে মূল্যায়ন করতে পারবো না এটার খারাপ দিকটা উপলব্ধি না করতে পারলে। এছাড়াও, খারাপ জিনিস বা কাজ পরিহার করাও এক ধরণের ভালো কাজ, যদি খারাপ কিছু না-ই থাকতো, তাহলে আমরা কিভাবে আমাদের চাহিদা ও কামনার বিরুদ্ধে কঠিন সংগ্রাম করে আল্লাহ সুবহানু ওয়াতালার আদেশ ও নিষেধাজ্ঞাগুলো মেনে চলতাম?
সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য বিশ্লেষণ
সৌভাগ্য এবং দুর্ভাগ্য এই দুইটাই এই জীবনের পরীক্ষার অংশ হিসাবে কেবল আল্লাহর(সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) পূর্বনির্ধারিত ঘটনা হয়ে থাকে।
দুঃখ কষ্টের মাধ্যমে পরীক্ষা
জীবনের দুঃখ কষ্ট আমাদের জন্য একরকমের পরীক্ষা, যেমনটি আল্লাহ বলেছেন:
“অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের।” {সুরাহ বাকারাহ, আয়াত ১৫৫}
আমাদের ধারণার বাহিরের জিনিসগুলো
কখনও কখনো আমাদের সাথে ঘটে যাওয়া খারাপ ঘটনার পিছে ভালো কিছু লুকিয়ে থাকে, আবার কখনো কখনো মানুষ এমন কিছু ভালো জিনিস চায় যা প্রকৃতপক্ষে তার জন্য ক্ষতিকর। আমরা হয়তো এই অবস্থাগুলো বুঝতে পারি না, কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ব্যাপারগুলো আমাদের সীমিত জ্ঞানের পরিধির বাহিরে থাকে।
… হয়তোবা কোন একটি বিষয় তোমাদের কাছে পছন্দনীয় অথচ তোমাদের জন্যে অকল্যাণকর। বস্তুতঃ আল্লাহই জানেন, তোমরা জান না। {সূরা আল বাকারাহ: আয়াত ২১৬}
সুতরাং, যদি কোনো ব্যক্তি অক্ষমতা নিয়ে জন্মে অথবা তার জীবন সংগ্রাম অত্যন্ত কঠিন হয় অথবা কোনো দুঃখ-দুর্দশা যখন কোনো ভালো মানুষকে আক্রান্ত করে, তাহলে তাকে বুঝে নিতে হবে যে এইসব আল্লাহ সুবহানু ওয়াতালার অনুমতি সাপেক্ষেই হয়েছে, যিনি সর্বাধিক জ্ঞানী, মেহেরবান এবং সর্বশ্রেষ্ট পরিকল্পনাকারী। সেইজন্যই, যা ঘটেছে তার পিছে অবস্যই বৃহত্তর কোনো ভালো উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে। হয়তো সেই ঘটনা ধরেই ভালো কিছু হতে যাচ্ছে অথবা সেই ঘটনায় দুর্ভোগের ও ধৈর্য ধারণের দরুন আল্লাহ সুবহানু ওয়াতালা সেই ব্যাক্তির গুনাহ মাফ করে দিতে পারেন।
সৌভাগ্য কবজ এবং তাবিজ
ভাগ্য যেহেতু পুরোটাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা নিয়ন্ত্রণ করেন, তাই সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে খরগোশের পা, জাদু কাঠি, গণক ঠাকুরের শুভ সংখ্যা, রাশিচক্র ইত্যাদিতে কখনোই বিশ্বাস করা উচিৎ না। একইভাবে, আয়না ভাঙ্গা, অশুভ সংখ্যা ১৩, কালো বিড়াল ইত্যাদি কখনোই মন্দ ভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা উচিৎ না। প্রকৃতপক্ষে, এইসব ভাগ্য নির্ধারক শুভ বা অশুভ প্রতীকের উপর বিশ্বাস, শিরকের মতো গুরুতর পাপ হিসেবে গণ্য হতে পারে, যা তৌহিদের পরিপন্থী।
একবার একদল মানুষ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট গেলেন আনুগত্য স্বীকার করার জন্য; তিনি সাঃ তাদের মধ্যে নয়জনকে গ্রহণ করলেন একজন বাদে। এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, উক্ত লোকটি একটি তাবিজ (সুরক্ষার কবজ হিসেবে) পরে ছিলেন। তাবিজ পরিহিত লোকটি তাৎক্ষণিক নিজের আলখেল্লার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে তাবিজটি ছিঁড়ে বের করে আনলেন ও সেটি ভেঙ্গে ফেললেন এবং তারপর তার আনুগত্য স্বীকার গ্রহণ করা হয়েছিল। তখন নবীজী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, ‘যে লোক তাবিজ পরবে সে যেন শিরক করলো।’ (আহমদ রাঃ হতে বর্ণিত, হাদীস: ১৬৯৬৯ শায়খ আল-আলবানি সহীহ শ্রেণীভুক্ত)। এই সংক্রান্ত আরো কয়েকটি সহিহ হাদীস রয়েছে, সুনানে আন-নাসাঈ; হাদীস ৪০৭৯ এবং ৫০৬৭ তে বর্ণিত হয়েছে যে, নবীজী মুহাম্মদ সাঃ তাবিজ ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছেন।
কুরআনের আয়াত দিয়ে তাবিজ
কুরআনের আয়াত চেইন বা থলির মধ্যে ঝুলিয়ে তাবিজ হিসেবে ব্যাবহার করা যায় কিনা এই ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে মতভেদ আছে, যে এগুলো আদৌ আমাদেরকে শয়তান থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে কিনা বা কল্যাণ বয়ে আনতে পারে কিনা; কিন্তু নবীজী (সাঃ) ও তার সাহাবীরা কখনো এরকম কিছু করেছেন বলে জানা যায় নি, তাই কিছু আলেমগণ এগুলোকে বিদ’আত বলে গণ্য করেন।
‘আয়িশা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘কেউ আমাদের এ শরী‘আতে নাই এমন কিছুর অনুপ্রবেশ ঘটালে তা প্রত্যাখ্যাত । {সহিহ বুখারী, হাদিস নং ২৬৯৭}
এই হাদীস দিয়ে বুঝা যায় যে, শরীয়তের দৃষ্টিতে দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু আবিস্কারকে বিদ’আত বলা হয় যা ৷ ‘ইব৷দাতের ক্ষেত্রে সেই সকল প্রকার ‘ইবাদাত অবৈধ যা কুরআন ও সুন্নাহের আওতাধীন।
একথা সত্য যে, সহীহ সূত্রে বর্ণিত আছে যে কুরআনের বিভিন্ন আয়াত রোগ নিরাময় বা প্রতিরক্ষার কাজ করতে পারে; উদাহরণস্বরূপ, সূরা আল-ফালাক আর আন-নাস , যাদুটোনার অনিষ্ট থেকে হেফাজতের জন্য ব্যাবহার করা হয়। কিন্তু, নবীজী (সাঃ) এই সূরা দুটি ব্যাবহারের যে পদ্ধতিগুলো শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন, তার মধ্যে তাবিজ ঝুলানোর কোনো প্রথা ছিল না। আরেকটি ভালো উদাহরণ হলো, কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে যে মধু এক রকমের সিফা (রোগ নিয়ন্ত্রণকারী) – এখন যদি কেউ মধু পান না করে গলায় ঝুলিয়ে রাখে তাহলে তো কি আদৌ কাজ করার কথা? একবার নিজেকেই প্রশ্ন করে দেখুন।
সারসংক্ষেপ
সুতরাং, আমরা যখন তাওহীদ আর-রুবূবীয়াহ এর কথা বলি, তখন আমরা আসলে সৃষ্টির প্রতিটি বস্তুর উপর আল্লাহর কর্তৃত্বের কথাই বলি; আমরা বিশ্বাস করি যে, সৃষ্টিজগতে তার অনুমতি ব্যতীত কিছুই ঘটে না। তবে, আমাদের সরাসরি আল্লাহকে কোন ক্ষতি, বিপর্যয় বা কুফলের কারণ হিসেবে দায়ী করা উচিত না, কারণ আমরা যেটাকে মন্দ বলে মনে করি তার পেছনে অবশ্যই কোনো না কোনো ভালো উদ্দেশ্য লুকিয়ে থাকে। যেহেতু সমস্তকিছুর উপরই আল্লাহর (সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) কর্তৃত্ব রয়েছে তাই আমাদের কেবল তার উপর এবং শুধুমাত্র তার উপরই নির্ভর করতে হবে; তিনি ব্যতীত অন্য যে কারো কাছে ক্ষতি থেকে সুরক্ষা চাওয়া, অথবা অন্য কারো কাছ থেকে ভালো কিছু পাওয়ার বা আত্ম উন্নতির আশা করা তাওহীদের মূল নীতিকে ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট।
তাওহীদ আল আসমা’ ওয়াছ-সিফাত (আল্লাহর নাম এবং গুণাবলীতে একতা বজায় রাখা)
এই ধরণের তাওহীদে আল্লাহর নাম এবং গুণাবলীতে একতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে প্রধান পাঁচটি বিষয় রয়েছে:
১. প্রথম বিষয়টি হলো, আল্লাহ স্বয়ং নিজেকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন এবং তাঁর প্রেরিত নবী যেভাবে তার বর্ণনা দিয়েছেন সেইভাবেই তাঁকে বর্ণনা করতে হবে
আল্লাহ কুরআনের মাধ্যমে নিজের বর্ণনা দিয়েছেন, যাতে আমরা তাঁর সম্পর্কে সঠিক ধারণা পোষণ করতে পারি। যদি আমরা অনুমান করা শুরু করি, তাহলে শেষে হয়তো আমরা হিন্দুদের মতো অবস্থায় গিয়ে দাঁড়াবো অসংখ্য দেবতা আর প্রতিমায় বিশ্বাস করে, অথবা হয়তো আমরা বৌদ্ধদের মতোই বিশ্বাস করা শুরু করবো যে, আমাদের আত্মার আধ্যাত্মিক যাত্রার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে গেলে অধীশ্বরে পরিণত হয়। কুরআনের অর্থে পরিষ্কার বোঝা যায়, আল্লাহ তা’আলা তাঁর সম্পর্কে ভূল অনুমান করাটা মোটেও পছন্দ করেন না:
এবং তিনি মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী এবং মুশরিক পুরুষ ও মুশরিক নারীদের শাস্তি প্রদান করেন – যারা আল্লাহ সম্পর্কে মন্দ ধারণা পোষণ করে।
{সূরা আল-ফাতাহ: আয়াত: ৬}
২. দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে নতুন কোনো নাম বা গুণাবলী দিয়ে আল্লাহকে বর্ণনা করা যাবে না
উদাহরণস্বরূপ, যদিও তিনি কুরআন শরীফে আমাদের জানিয়েছেন যে, তিনি মাঝে মাঝে রাগান্বিত হন; কিন্তু তাই বলে আল্লাহকে আল-গাল্লীব (রাগান্বিত) বলা যাবে না। আমরা চাইলেই এই ধরণের নাম ব্যবহার করতে পারি না; কারণ স্বয়ং আল্লাহ বা তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই নামটি ব্যবহার করেননি। সহজ কথায়, আমরা আমাদের ঈশ্বরকে অনুমানের ভিত্তিতে বর্ণনা দিতে পারি না।
৩. তৃতীয় বিষয় অনুযায়ী আল্লাহকে কখনোই তাঁর সৃষ্টির গুণাবলী দেয়া যাবে না
উদাহরণস্বরূপ, খ্রিস্টানরা এবং ইহুদিরা বিশ্বাস করে (বাইবেল ও তাওরাত হতে বর্ণিত) যে ঈশ্বর প্রথম ছয়দিনে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেন এবং তারপর সপ্তম দিনে তিনি বিশ্রাম নিয়েছিলেন (আদিপুস্তক বা জেনেসিস ২.২)। এটি তাঁর ক্লান্ত হবার বৈশিষ্ট্যকে ইঙ্গিত করে – যেমন তাঁর সৃষ্ট বান্দারা দীর্ঘ পরিশ্রমের পর ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আমাদের সুপরিচিত আয়াত-উল-কুরসীতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি কখনো ক্লান্তবোধ করেন না এবং তন্দ্রা বা ঘুম কখনো তাকে ছুঁতে পারে না। বাইবেল এবং তাওরাতের কয়েক জায়গায় বলা হয়েছে যে, ঈশ্বর তাঁর মন্দ চিন্তাগুলোর জন্যে অনুশোচনায় ভুগেছিলেন, যেমনটা মানুষ করে। যাত্রাপুস্তক বা বুক অফ এক্সোডাসের ৩২ স্তবকের ১৪ ভার্সে বলা হয়েছে যে, ঈশ্বর তাঁর সৃষ্ট মানুষদের উপর যা করতে চেয়েছিলেন তাঁর জন্য স্বয়ং ঈশ্বরই অনুতপ্ত হয়েছিলেন।
আরেকটি অগ্রহণযোগ্য ধারণা হলো, আল্লাহ তা’আলা আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই উপস্থিত আছেন – আমাদের রূহ বা আত্মা হয়ে। কুরআনের কোথাও আল্লাহ নিজেকে আত্মা হিসেবে দাবী করেননি কিংবা তাঁর নবী রাসূল (সাঃ) হাদীসে এই সংক্রান্ত কোনো বিষয়েই কিছু বলেননি।
আল্লাহর গুণাবলী সম্পর্কে কথা বলার সময়ে, কুরআনে বর্ণিত সূত্রের আলোকে যে মূল নীতিটিকে অনুসরণ করা উচিত তা হচ্ছে,
“… কোন কিছুই তাঁর অনুরূপ নয়। তিনি সব শুনেন, সব দেখেন।
{সূরা আস শুরা: আয়াত ১১}
যদিও দেখার এবং শোনার বৈশিষ্ট্যগুলো মানবিক গুণাবলীর মধ্যেই পড়ে, তবে এই ব্যাপারগুলো যখন আল্লাহর (সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) ক্ষেত্রে আরোপিত হয়, তখন এসবের পরিপূর্ণতা তুলনা করা যায় না। সুতরাং আমাদের অবশ্যই এটা বুঝতে হবে যে, তিনি সবই দেখেন এবং সবই শোনেন; তবে আমাদের মতো করে নয় কিংবা তাঁর সৃষ্ট অন্য কোনো সৃষ্টির মতো করে নয়।
উদাহরণস্বরূপ (কেবল বুঝানোর স্বার্থে), পর্বতের মাথা আর মানুষ বা অন্য কোনো জন্তুর মাথা এক হয় না, কারণ পর্বতের নাক, কান এবং মুখ হয় না। একইভাবে, আল্লাহর কোনো গুণাবলীর সাথে তার সৃষ্ট কোনো কিছুর গুণাবলী কখনোই তুলনা করা উচিত না।
সুতরাং, আমরা কখনোই আল্লাহকে কোনো চিত্র বা প্রতিমার আকারে চিত্রিত করার চেষ্টা করি না। যদি আমরা তা করতে চাই, তাহলে তাঁকেও কোনো একটা সৃষ্টির মতই চিন্তায় ধারণ করে ফেলা অবশ্যক হয়ে যাবে।
৪. চতুর্থ বিষয়টি হচ্ছে আল্লাহর গুণাবলী মানুষের উপর আরোপিত না করা
উদাহরণস্বরূপ, তাওরাতের নতুন টেস্টামেন্টে (আদিপুস্তক বা জেনেসিস ১৪:১৮-২০) অনুযায়ী পল এমন ধারণা পোষণ করে যে মেলচিযেদেকের (সালামের রাজার) কোনো শুরু কিংবা শেষ নেই। এই একই বৈশিষ্ট্য যীশুকেও দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) বৈশিষ্ট বা স্বর্গীয় গুণ – যে তাঁর কোনো শুরুও নেই কোনো শেষও নেই।
কোনো মানুষকেই নিম্নবর্তী স্বর্গীয় গুনাবলী দেওয়া উচিত না, যেমন:
- চির-অভ্রান্ত (তারা কখনো ভুল করতেই পারে না);
- অতীত, ভবিষ্যত এবং অদৃশ্যের ব্যাপারে জ্ঞানী;
- ভাগ্য পরিবর্তন করতে সক্ষম এবং সৃষ্টির অণু-পরমাণু নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম।
খ্রিস্টানরা যীশুকে ঈশ্বরের গুণাবলীতে গুণান্বিত করেছেন। আমরা বিশ্বাস করি যে, তিনি আল্লাহর অন্যতম একজন নবী ছিলেন; কিন্তু খ্রিস্টানরা তাকে অগ্রহণযোগ্য উচ্চতায় তুলে ধরেছে। তাদের নিজস্ব ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে যে, যীশু প্রার্থণা করেছিলেন, যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হয় তিনি কার কাছে প্রার্থণা করেছিলেন – তাদের কাছে এই প্রশ্নের গ্রহণযোগ্য কোনো উত্তর পাওয়া যায় না ।
৫. পঞ্চম এবং চূড়ান্ত বিষয়টি হলো আল্লাহর নাম হুবাহু তাঁর কোনো সৃষ্টিকে দেয়া যাবে না
আল্লাহ তা’আলার নামসমূহ কোনোভাবেই তাঁর সৃষ্টিকে দেয়া যাবে না। অবশ্য যদি সেই নামের আগে “আব্দ” শব্দটি ব্যবহার করা হয়, যার অর্থ “দাস” বা “আল্লাহর বান্দা”, তাহলে কোনো সমস্যা নেই।
উদাহরণস্বরূপ, আল্লাহর নামগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে আর-রহিম, যার অর্থ অতি দয়ালু। তিনিই সবচেয়ে দয়ালু, তাই আমরা চাইলেই কারো নাম আর-রহিম রাখতে পারি না; তবে আমরা নিশ্চিন্তেই আবদুর রহিম নাম রাখতে পারি।
একইভাবে, আমরা কোনো মানুষের দাস হিসেবে কারো নাম রাখতে পারিনা যেমন আবদুর-রসুল (রাসূলের দাস), আবদুন-নবী (নবীর দাস), আবদুর-হুসেন (হুসেনের দাস) ইত্যাদি; আমাদের নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও এটি নিষেধ করেছেন (সুনানে আবু দাউদ এ, হাদীস নং ৪৯৭৫)।
সুতরাং, আমাদের সন্তানদের এবং পরবর্তী মুসলিম প্রজন্মের নাম রাখার ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত।
আমাদের মৃত ব্যক্তিদেরকে ডাকা উচিত না কারণ তারা সাড়া দিতে পারে না
ধরুন, হটাৎ আপনার গাড়ির চাকা নষ্ট হয়ে গেল, আপনি রাস্তার কাউকে সাহায্যের জন্য ডাকতেই পারেন। তবে এই অবস্থায় আমরা কি এমন কাউকে ডাকি যে সেইখানে অনুপস্থিত বা ইতিমধ্যে মারা গিয়েছে? আমরা সকল ক্ষেত্রেই শুধু আল্লাহকে আমাদের প্রার্থণায় ডাকি এবং শুধু তাঁর কাছেই দুআ করি। এমনকি আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেও ডাকতে পারি না, কারণ তিনি মারা গেছেন।
আরবিতে “ইয়া” শব্দটি কাউকে ডাকার কাজে ব্যবহৃত হয়, যেমন “ইয়া আবদুল” যার অর্থ “ও আবদুল” বা “এই আবদুল”। সুতরাং, আমরা কোন মৃত মানুষের নামের পূর্বে “ইয়া” শব্দটি ব্যাবহার করা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করবো।
তাওহীদ আল-ইবাদাহ (ইবাদতের একত্ব বজায় রাখা)
ইসলামিক দৃষ্টিতে তাওহীদ পরিপূর্ণ হতে প্রথম দুই শ্রেণী তাওহীদের পাশাপাশি তাওহীদ আল-ইবাদাহের উপস্থিতিও জরুরী। এর অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর ইবাদাতের একত্ব বজায় রাখা।
একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করা
সকল ধরণের ইবাদত কেবল আল্লাহ তা’আলার (সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) জন্যই হাওয়া উচিৎ, কারণ তিনিই একমাত্র ইলাহ যিনি ইবাদতের হকদার। আমরা বিশ্বাস করি যে, আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত উপাসনার যোগ্য আর কোন সত্তা নেই।
আল্লাহ এবং আমাদের মধ্যে কোনো মধ্যস্থতাকারী নেই
আমাদের এবং আল্লাহের মধ্যে কোনো ধরণের সুপারিশকারী বা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাউকে বিবেচনা করা উচিৎ না। আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) মানব জাতি এবং জ্বিন জাতি সৃষ্টির মূল ও একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবে সরাসরি তাঁর ইবাদত করার গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছেন {সূরা আয-যারিয়্যাত; আয়াত ৫৬)}। আল্লাহ আরো বলেছেন যে, তিনি প্রত্যেক জাতির নিকটই রাসুল প্রেরণ করেছেন, যারা তাদের আল্লাহর ইবাদত করতে বলেছে এবং মিথ্যা দেবতা পূজা থেকে নিরাপদ থাকার কথাও বলেছেন {সূরা আন-নাহল; আয়াত ৩৬}।
আমাদের কোনো মধ্যস্থতাকারীর দরকার নেই, এই মর্মে কুরআনে অনেক আয়াত রয়েছে; আল্লাহ যে আমাদের নিকটবর্তী, এসব আয়াতে তারই প্রমাণ পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ সূরা বাকারার ১৮৬ তম আয়াতের কথাই বলা যায়, যেখানে আল্লাহ তা’আলা আমাদের নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলেছেন,
“আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে বস্তুতঃ আমি রয়েছি সন্নিকটে। যারা প্রার্থনা করে, তাদের প্রার্থনা কবুল করে নেই, যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে। কাজেই আমার হুকুম মান্য করা এবং আমার প্রতি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস করা তাদের একান্ত কর্তব্য। যাতে তারা সৎপথে আসতে পারে।”
কুরআন ও সুন্নাহর আঙ্গিকে ধর্মীয় ধারণাগুলোকে বুঝতে হবে
‘আবদুল্লাহ (ইবনু মাসঊদ) (রাঃ) সূত্রে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, আমার যুগের লোকেরাই সর্বোত্তম ব্যক্তি, অতঃপর যারা তাদের নিকটবর্তী। অতঃপর যারা তাদের নিকটবর্তী। এরপর এমন সব ব্যক্তি আসবে যারা কসম করার আগেই সাক্ষ্য দিবে, আবার সাক্ষ্য দেয়ার আগে কসম করে বসবে। ইবরাহীম (নাখ্ঈ) (রহঃ) বলেন, আমাদেরকে সাক্ষ্য দিলে ও অঙ্গিকার করলে মারতেন।
(সহীহ বুখারী : হাদিস ২৬৫২)।
সুতরাং, কুরআন ও সুন্নাহর বিশদ-ব্যাখ্যা বুঝতে আমাদেরকে অবশ্যই সাহাবাদের ব্যাখ্যা তারপর তাবে-তাবেইনদের ব্যাখ্যা বুঝতে হবে। আমাদেরকে অবশ্যই আমাদের ধর্মের মূল ধারণাটি বুঝতে হবে, এবং নতুন নতুন প্রথা আবিষ্কার করা এড়িয়ে ইবাদতের একত্ব বজায় রাখতে হবে।
বিদআহ কতটা বিপজ্জনক
‘আওফ বিন মালিক (রাঃ) হইতে বর্ণিত হাদিসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “অবশ্যই আমার উম্মাত তিয়াত্তর ফেরকায় বিভক্ত হবে। তার মধ্যে একটি মাত্র ফেরকা হবে জান্নাতী এবং অবশিষ্ট বাহাত্তরটি হবে জাহান্নামী।” {সুনানে ইবনে মাজাহ ৩৯৯২}। যখন সাহাবীরা নবীজিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন কোন দলটি জান্নাতে যাবে? উত্তরে নবীজি বলেছিলেন, যে দলে আমি আর তোমরা আছো (অর্থাৎ, নবীজি ও তার সাহাবীরা যে পথে নিজেদেরকে পরিচালিত করেছেন)।
এই হাদীসটি এমনটি ইঙ্গিত করে না যে বেশীরভাগ মুসলিমরা জাহান্নামে যাবে, বরং এই ব্যপারটি ইঙ্গিত করে যে আমাদেরকে এই ধর্মটির বিভিন্ন প্রকার সংস্করণের মুখোমুখি হতে হবে।
সুতরাং, আমাদের উচিত সেই ইবাদতে একত্ব বজায় রাখা এবং রাসূল (সাঃ), তার সাহাবীরা এবং তাঁর সত্য অনুসারীরা যেই পথে চলেছেন সেই পথ অনুসরণ করা। আমাদের উচিত আল্লাহ সুবহানু ওয়াতায়ালা প্রদত্ত ইবাদতের পদ্ধতি মেনে চলা এবং আমাদের দ্বীনের পথে নতুন নতুন প্রথা পরিহার করা; যা ইসলামে বিদ’আত হিসেবে পরিগণিত হয়।
নতুন প্রথা ধর্মকে পুরোপুরি পরিবর্তন করে ফেলতে পারে এবং এর মৌলিক বিশুদ্ধতাকে বিকৃতও করতে পারে; তাই যদি কোনো বিষয় আমাদের ধর্ম সংক্রান্ত হয়ে থাকে, তবে অবশ্যই সেটা কুরআন আর সুন্নাহ দ্বারা পরিচালিত কিনা তা বিষদ বিবেচনা করে দেখতে হবে। যদি তা না হয় তাহলে আমাদের সেটি এড়িয়ে চলা উচিত।
উদাহরণস্বরূপ, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, জামা’আতে নামাজ আদায়ের ফযীলত একাকী নামাজ আদায় অপেক্ষা সাতাশ গুণ বেশী {সহীহ আল-বুখারী হাদিস ৬৪৫}। আবার আমরা এও জানি যে, নবীজী (সাঃ) মসজিদে প্রবেশ করে দুই রাকাত নফল নামাজ (তাহিয়াত এল-মসজিদ) আদায়ের ব্যাপারেও উৎসাহিত করেছেন। তবে, আমরা এই দুটিকে একত্রিত করে জামা’আতে দুই রাকাত তাহিয়াত এল-মসজিদ নামাজ পড়া শুরু করতে পারি না – যেহেতু এটি এমন একটি নতুন প্রথা হবে যা নবীজী আমাদের কখনো করতে শিখিয়ে যান নি – সেইজন্য এটি একটি বিদ’আত হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে।
আমাদের মনে হতে পারে যে, কিছু বিদআত হয়তো আমাদেরকে আল্লাহর আরো নিকটবর্তী করবে, কিন্তু আসলে এটি আমাদেরকে তাঁর থেকে আরো দূরে সরিয়ে দিতে পারে – তা যতই যৌক্তিক মনে হোক না কেন। মূল নীতিটা হলো – সর্বোত্তম কালাম হল আল্লাহ্র কিতাব, আর সর্বোত্তম পথ নির্দেশনা হল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) – এর পথ নির্দেশনা। আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হল নতুনভাবে উদ্ভাবিত পন্থাসমূহ {সহীহ আল-বুখারী ৭২৭৭}। সুতরাং আমরা আল্লাহ তা’আলার ইবাদত সেইভাবেই করার যথাসাদ্ধ চেষ্টা করবো যেভাবে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন।
আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো কিছুই আমাদের ক্ষতি বা উপকার করতে পারে না
আমাদেরকে এই কথাও বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহ তা’আলার অনুমতি ব্যতীত জগতের কোনো কিছুই আমাদের কোনো উপকার বা ক্ষতি করতে পারে না তাই আমাদের একমাত্র তাঁরই ইবাদত করতে হবে:
তিনি (আল্লাহ) বলেন, “তোমরা কি আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদত কর, যা তোমাদের কোন উপকারও আসে না কিংবা ক্ষতিও করতে পারে না।” {সূরা আল-আম্বিয়া; আয়াত ৬৬}।
তাই যে কোনো ধরণের উপকারের কিংবা ক্ষতির আশায় আমাদের অন্য কোনো সত্ত্বার উপর ভরসা করা উচিত নয় কারণ সাহায্য, বরকত ও সুরক্ষা কেবল আল্লাহ সুবহানু ওয়াতা’আলার পক্ষ থেকেই আসে।
আমাদের অবশ্যই আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত অন্য কারো কাছে গায়েবী সাহায্য প্রার্থণা করা উচিত নয়, যেহেতু আল্লাহ বলেই দিয়েছেন, “আর যদি আল্লাহ তোমাকে কষ্ট দিতে চান, তবে তিনি ব্যতীত তা অপসারণকারী আর কেউ নেই…” {সূরা আন-আনাম; আয়াত ১৭}। যদি কেউ ফেরেশতা, জ্বিন, নবীগণ কিংবা সাধু-সন্ন্যাসীদের কাছে দুআ প্রার্থণা করে তাহলে এই কাজটি সবচেয়ে বড় পাপ, শিরকে পরিণত হতে পারে।
আদি-ইসলামিক মক্কাবাসীদের ধারণা
কুরআন দিয়ে প্রমাণিত যে, ইসলাম ধর্ম আসর আগে মক্কাবাসীরা আল্লাহকেই তাদের মূল এবং সর্বোচ্চ ঈশ্বর বলে বিশ্বাস করতো, তবে তারা আল্লাহর পাশাপাশি মূর্তি পূজাও করতো।
“এবং আপনি যদি তাদের জিজ্ঞেস করেন, নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডল কে সৃষ্টি করেছে? তারা অবশ্যই বলবে, “আল্লাহ”… (সূরা লোকমান; আয়াত ২৫)।
কিন্তু যখন তাদেরকে জিজ্ঞেস করা হতো, তাহলে কেন তারা প্রতিমাগুলোর উপাসনা করে, তখন তারা জবাবে বলতো:
“আমরা তাদের ইবাদত এ জন্যেই করি, যেন তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়…” (সূরা আয-যুমার; আয়াত ৩)।
সুতরাং, আমাদের পাপ হইতে মুক্তিলাভের আশায় এবং আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে কোনো কিছু হাসিলের উৎস্য হিসেবে কোনো মধ্যস্থতাকারী গ্রহণের করার উচিত না। এই ভাবে মানুষের সুপারিশকারীকে ইবাদতে মশগুল হয়ে পড়ার সম্ভাবনা গড়ে উঠে। এইভাবে তারা অনুমান করতে শুরু করে যে তাদের সেই সুপারিশকারীই তাদের রক্ষা করবে আর এই ধারণা নিয়েই আল্লাহ তায়ালার অবাধ্য হওয়া শুরু করে।
উপাসনার বর্ধিত ধারণা
ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপাসনা (ইবাদত) এর মধ্যে রোজা, নামাজ, যাকাত, হজ্ব এবং পশু কোরবানি ছাড়াও আরো অনেক কিছুই অন্তর্ভূক্ত আছে। এর মধ্যে ভালোবাসা, ভয় এবং বিশ্বাসের মতো আবেগ-অনুভূতিও অন্তর্ভূক্ত রয়েছে:
আর কোন লোক এমনও আছে যারা অন্যান্যকে আল্লাহর সমকক্ষ সাব্যস্ত করে এবং তাদের প্রতি তেমন ভালোবাসা প্রদর্শন করে, যেমন আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা হয়ে থাকে। কিন্তু যারা আল্লাহর প্রতি ঈমানদার তাদের ভালোবাসা ওদের তুলনায় বহুগুণ বেশী … (সূরা আল-বাকারাহ; আয়াত ১৬৫)।
… তোমারা কি তাদের ভয় করো? অথচ তোমাদের ভয়ের অধিকতর যোগ্য হলেন আল্লাহ, যদি তোমরা মুমিন হও। (সূরা আত-তাওবাহ; আয়াত ১৩)
… আর আল্লাহর উপর ভরসা করো, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও। (সূরা আল-মায়েদাহ; আয়াত ২৩)
সুতরাং, তাওহীদ-আল-ইবাদাহ এর একটি গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য অংশ শরীয়াহ বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত, তাই কুরআন এবং সুন্নাহ সম্পর্কে জানা এবং বুঝতে পারা আমাদের একান্ত দায়িত্ব এবং কর্তব্য, যেন সেগুলোকে আমরা সম্মিলিত ভাবে আমাদের জীবন-যাপনে, আত্মিক ভাবে ও বিবেক-বুদ্ধি ব্যাবহারের ক্ষেত্রে প্রকৃতরূপে যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারি।
উপসংহার
সুতরাং, সৃষ্টিকর্তার তাওহীদের প্রসিদ্ধ জ্ঞান অর্জন করা বিশ্বাসীদের একান্ত কর্তব্য – কারণ এটাই আমাদের বিশ্বাসের মূল ভিত্তি, কেননা এই জ্ঞান প্রয়োগের মাধ্যমেই আমরা ভ্রান্ত ধারণাগুলো থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি।
আল্লাহ্ আমাকে ও আপনাদের সবাইকে সঠিক পথনির্দশনা দান করুন, আমীন!