আদম আঃ ও হাওয়া রাঃ শয়তানের দ্বারা প্রতারিত হয়েছিল
আমরা সবাই সম্ভবত জানি যে, সর্ব প্রথম আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আদম আঃ কে সৃষ্টি করেছেন এবং পরবর্তীতে হাওয়া রাঃ কে সৃষ্টি করা হয়। ইবলিস একজন ধার্মিক ও ধর্মনিষ্ঠ জিন ছিলেন, একসময় তাকে আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আদম আঃ কে শুধুমাত্র সম্মান দেখানোর জন্য (উপাসনা করার জন্য নয়) সেজদা করতে আদেশ দিলেন। সকল উপাসনা শুধুমাত্র আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) জন্যই আর কারো জন্য নয়। কিন্তু ইবলীস তার অহংকারের কারণে আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) আদেশ অনুসরণ করতে অস্বীকার করে এবং শয়তানে রূপান্তরিত হয়।
সুতরাং ইবলীস, আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলার) কাছে কেয়ামতের দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকার জন্য অনুমতি চায় এবং ওয়াদা করে যে সে মানব জাতিকে বিভ্রান্ত করে পথভ্রষ্ট করবে। ইবলীসকে অনুমতি দেয়া হয়।
আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আদম আঃ ও হাওয়া রাঃ কে বেহেস্তে বসবাস করার অনুমতি দিলো এবং এর সবকিছু উপভোগ করার অনুমতি দিলো, একটি জিনিস ব্যতীত, তাদেরকে একটি নিষিদ্ধ বৃক্ষের কাছে যেতে ও তার ফল খেতে মানা করা হয়।
শয়তান, আদম আঃ ও হাওয়া রাঃ সেই নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খেতে প্রলুব্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল এবং এর ফলে তাদেরকে পৃথিবীতে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জীবনধারণ করতে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলোচনা করা যাক:
একটি গাছ থেকে খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল
এবং আমি আদমকে হুকুম করলাম যে, তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস করতে থাক এবং ওখানে যা চাও, যেখান থেকে চাও, পরিতৃপ্তিসহ খেতে থাক, কিন্তু এ গাছের নিকটবর্তী হয়ো না। অন্যথায় তোমরা যালিমদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে পড়বে।
{সূরা আল-বাক্বারাহ: আয়াত ৩৫}
আদম আঃ এবং হাওয়া রাঃ জানতো যে তাদের সেই নিষিদ্ধ গাছের ফল খাওয়ার অনুমতি ছিল না। আদম আঃ অবশ্য একজন মানুষ, আর মানুষ মাত্রই ভুলে যায়। মানব হৃদয় দুর্বল হয় যা ভুলে যায় ও পরিবর্তিত হয়। ইবলীস, তার হিংসার মধ্যে ডুবে থেকে, আদম আঃ কে (তার মানব-প্রকৃতির সুযোগ নিয়ে) বিভ্রান্ত করতে থাকে। সে তাদের হৃদয়ে দিনের পর দিন কুমন্ত্রণা দিতে থাকে: “আমি কি তোমাদেরকে অমরত্বের বৃক্ষ এবং চিরস্থায়ী রাজ্যের পথনির্দেশনা দিবো?” ইবলীস আরো বলে যায়: “নিশ্চয় তোমাদের পালনকর্তা তোমাদেরকে এ বৃক্ষ থেকে খেতে নিষেধ করেননি, কিন্তু তা তোমাদেরকে ফেরেশতা ও অমর বানিয়ে দেবে” আর শয়তান আল্লাহর শপথ নিয়ে বলে “অবশই আমি তোমাদের শুভাকাঙ্খী।”
আদম আঃ এর দুর্বলতা বর্ণিত হয়:
আমি ইতিপূর্বে আদমকে নির্দেশ দিয়েছিলাম। অতঃপর সে ভুলে গিয়েছিল এবং আমি তার মধ্যে দৃঢ়তা পাইনি।
{সূরা ত্বোয়া-হা: আয়াত ১১৫}
শয়তান তাদেরকে মিথ্যা বলে প্রতারিত করেছিল:
অতঃপর শয়তান তাকে কুমন্ত্রনা দিল, বললঃ হে আদম, আমি কি তোমাকে বলে দিব অনন্তকাল জীবিত থাকার বৃক্ষের কথা এবং অবিনশ্বর রাজত্বের কথা?
{সূরা ত্বোয়া-হা: আয়াত ১২০}
অতঃপর শয়তান উভয়কে প্ররোচিত করল… “তোমাদের পালনকর্তা তোমাদেরকে এ বৃক্ষ থেকে নিষেধ করেননি; তবে তা এ কারণে যে, তোমরা না আবার ফেরেশতা হয়ে যাও-কিংবা হয়ে যাও চিরকাল বসবাসকারী। সে তাদের কাছে [আল্লাহর] কসম খেয়ে বললঃ আমি অবশ্যই তোমাদের হিতাকাঙ্খী।
{সূরা আল-আ’রাফ: আয়াত ২০-২১}
দুজনেই গাছ থেকে খেয়েছিলো
বহুবছর পার হয়ে যায়, এবং আদম আঃ এবং হাওয়া রাঃ সে গাছের চিন্তায় ডুবে থাকে। তারপর, একদিন, তারা তার ফল খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। তারা ভুলে গিয়েছিলো, যে আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) তাদেরকে গাছটির নিকটবর্তী হতে নিষেধ করেছেন ও শয়তান হতে সাবধান করেছিলেন যে ইবলীস তাদের পরম শত্রূ। সুতরাং তারা দুজনেই সেই নিষিদ্ধ গাছ থেকে ফল খেলো যা আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) আমাদেরকে পবিত্র কুরআনে অবহিত করলো:
অতঃপর তারা উভয়েই এর ফল ভক্ষণ করল, তখন তাদের সামনে তাদের লজ্জাস্থান খুলে গেল এবং তারা জান্নাতের বৃক্ষ-পত্র দ্বারা নিজেদেরকে আবৃত করতে শুরু করল। আদম তার পালনকর্তার অবাধ্যতা করল, ফলে সে পথ ভ্রষ্ঠ হয়ে গেল।
{সূরা ত্বোয়া-হা: আয়াত ১২১}
অতঃপর প্রতারণাপূর্বক তাদেরকে সম্মত করে ফেলল। অনন্তর যখন তারা বৃক্ষ আস্বাদন করল, তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের সামনে খুলে গেল এবং তারা নিজের উপর বেহেশতের পাতা জড়াতে লাগল। …
{সূরা আল-আ’রাফ: আয়াত ২২}
আদম আঃ তাদের দোষ স্বীকার করেছিলেন
…আর তাদের প্রতিপালক তাদেরকে ডেকে বললেনঃ আমি কি তোমাদেরকে এ বৃক্ষ থেকে নিষেধ করিনি এবং বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রূ। তারা উভয়ে বললঃ হে আমাদের পালনকর্তা আমরা নিজেদের প্রতি জুলম করেছি। যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ না করেন, তবে আমরা অবশ্যই অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যাব।
{সূরা আল-আ’রাফ: আয়াত ২২-২৩}
তাদেরকে নির্দিষ্ট সময়ের একটি জীবন যাপন করার জন্য শয়তানের সাথে পৃথিবীতে পাঠানো হয়
আল্লাহ(সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) তাদেরকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিলো সেখানে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বসোবাস করতে ও জীবন ধারণ করতে, তারপর তারা মারা যাবে এবং আবার পুনরুত্থিত হবে।
আল্লাহ বললেনঃ তোমরা নেমে যাও। তোমরা এক অপরের শত্রু। তোমাদের জন্যে পৃথিবীতে বাসস্থান আছে এবং একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত ফল ভোগ আছে। তিনি বললেনঃ তোমরা সেখানেই জীবিত থাকবে, সেখানেই মৃত্যুবরন করবে এবং সেখান থেকেই পুনরুঙ্খিত হবে।
{সূরা আল-আ’রাফ: আয়াত ২৪-২৫}
এবার বাইবেল এর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলোচনা করা যাক:
তিমথি ১, অধ্যায় ২, পদ্য ১৪-১৫ অনুযায়ী
আদমকে দিয়াবল বোকা বানাতে পারে নি; কিন্তু নারীকেই দিয়াবল সম্পূর্ণভাবে বোকা বানিয়ে পাপে ফেলেছিল। তবু যদি আত্মসংযমের সাথে বিশ্বাসে, প্রেমে ও পবিত্রতায় তারা জীবনযাপন করতে থাকে, তবে নারী মাতৃত্বের দাযিত্ব পালন করে উদ্ধার পাবে।
আদিপুস্তক ৩, অধ্যায় ৩, এর মতে,
এই অধ্যায়ের পুরো ঘটনাটি নিম্নরূপ:
সংক্ষেপে বলতে গেলে, স্বর্গে একটি সর্প ছিল যা ইভ(হাওয়া)-কে জিজ্ঞাসা করলো, “সেখানে কোন গাছ থেকে কি ঈশ্বরের তাদেরকে খেতে নিষেধ করেছেন?” তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমাদেরকে স্বর্গের মাঝখানে শুধুমাত্র একটি গাছের ফল স্পর্শ করার অনুমতি দেওয়া হয় নাই, অন্যথায় আমরা মারা যাব। সর্পটি বললো, তোমরা যদি ঐ গাছের ফল খাও তাহলে তোমরা মরবে না বরং তোমাদের ভালো আর মন্দের জ্ঞান হবে, আর তোমরা তখন ঈশ্বরের মত হয়ে যাবে! তাই ইভ সুন্দর গাছটির দিকে তাকালো, এর ফল সুস্বাদু লাগলো, সে চিন্তা করলো গাছটি তাকে জ্ঞান দেবে। তাই ইভ গাছটার থেকে ফল নিয়ে খেল ও স্বামীকেও খেতে দিল। তখন তাদের চোখ খুলে গেল আর তারা দেখল তাদের কোনও জামাকাপড় নেই (তারা উলঙ্গ) তাই তারা পাতা জোগাড় করে সেগুলোকে পোশাক হিসেবে পড়তে লাগলো। তারা ঈশ্বরের পায়ের শব্দ শুনে গাছগুলির মাঝখানে গিয়ে লুকালো। ঈশ্বর ডাকলেন, “তুমি কোথায়?” আদম বলল, “আমি উলঙ্গ তাই আপনার শব্দ শুনে ভয়ে লুকিয়ে আছি।” ঈশ্বর বললেন, “যে গাছটার ফল খেতে আমি নিষেধ করেছিলাম তুমি কি সেই বিশেষ গাছের ফল খেয়েছ?” সে বলল, “আমার জন্য যে নারী আপনি তৈরী করেছিলেন সে গাছটা থেকে আমায় ফল দিয়েছিল, তাই আমি সেটা খেয়েছি।” তখন ঈশ্বর ইভ-কে বললেন, “তুমি এ কি করেছ?” সে বলল, “সাপটা আমার সঙ্গে চালাকি করেছে। সাপটা আমায় ভুলিযে দিল আর আমিও ফলটা খেয়ে ফেললাম।”
ঈশ্বর শাস্তি দিলেন
সুতরাং ঈশ্বর সাপটাকে বললেন: “তুমি ভীষণ খারাপ কাজ করেছ; সমস্ত জীবন তুমি বুকে হেঁটে চলবে আর মাটির ধুলো খাবে। তোমার এবং নারী জাতির মধ্যে শত্রূতা বয়ে চলবে। তুমি কামড় দেবে তার সন্তানের পায়ে কিন্তু সে তোমার মাথা চূর্ণ করবে।”
তারপর ঈশ্বর ইভকে বললেন,“তোমার জন্য গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মদান অত্যন্ত কষ্টকর ও বেদনাদায়ক করে দিলাম। তুমি তোমার স্বামীকে আকুলভাবে কামনা করবে কিন্তু সে তোমার উপরে কর্তৃত্ত্ব করবে।”
তারপর ঈশ্বর আদমকে বললেন,“যেহেতু তুমি আমার মানা করা সত্ত্বেও ইভ-এর কথা শুনে নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়েছ, তাই এই ভূমিকে অভিশাপ দিলাম। সারাজীবন তোমাকে অতি কঠিন পরিশ্রম করে ভূমি থেকে খাদ্য উৎপাদন করতে হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তুমি মারা গিয়ে আবার ধূলিতে পরিণত হবে। ধুলি থেকে তোমার সৃষ্টি এবং মৃত্যুর পর পুনরায় তুমি ধূলিতে পরিণত হবে।”
উপসংহার
বাইবেল অনুসারে, ইভ সর্প দ্বারা প্রতারিত হয়ে নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়েছিলো। সে সর্পের কথা শুনে এটা খেয়েছিলো এবং আদম আঃ-কেও কিছুটা খাওয়েছিলো। সেই মুহূর্তেই, তাদের চোখ খুলে গিয়েছিলো আর তারা নিজেদেরকে উলংগ অবস্থায় দেখলো, এবং তারা গাছের পাতা দিয়ে নিজেদেরকে আবৃত করা শুরু করেছিল।
এই ঘটনাটি কুরআনের আয়াত দ্বারা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। পবিত্র কুরআনে হাওয়া রাঃ কে কোথাও সেভাবে দোষারূপ করা হয়নি। এরকম হলে তা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ থাকার কথা ছিল। এমনকি, ইবনে কাসীর আদম আঃ এর জীবনীতে উল্লেখ করেছেন যে, আদম আঃ প্রথমে গাছ থেকে ফল পেড়ে তারপর তার স্ত্রীর সাথে এটি ভাগ করে খেয়েছিলেন। পবিত্র কুরআনে বহুবার আমাদেরকে আদম আঃ, হাওয়া রাঃ এবং ইবলীসের ঘটনা মনে করানো হয়েছে নিম্ন লিখিত ব্যাপারগুলো সম্পরকে সাবধান করার জন্য:
- এসব কিভাবে শুরু হলো?
- আমরা কিভাবে এই পৃথিবীতে এলাম?
- আমরা এখানে কেন এলাম এবং আমাদের জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী?
- আমাদের আসল শত্রূ কে এবং তার প্রকৃত উদ্দেশ্য কি?
- আমাদের সৃষ্টিকর্তা কে এবং কিভাবে তিঁনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং প্রতিপালন করে যাচ্ছেন?
- সর্বশেষে, এটা আমাদেরকে উপলব্ধি করায় যে আমরা শয়তানকে অনুসরণ করে আসলে নিজেদেরই ক্ষতিসাধন করি তাই আমাদের ক্রমাগত আমাদের সৃষ্টিকর্তার কাছে শয়তান থেকে আশ্রয় চেয়ে নিজেদের রক্ষা করা উচিৎ।