Islam-beliefs

বিস্তারিত: বিচার দিবসের আগে মৃত ব্যক্তিদের সাথে কি ঘটে এবং আমরা তাদের জন্য কি করতে পারি?

Table of Contents

মৃত্যু আসলে কি?

সূরা আল  ইমরান এর ১৮৫ নং আয়াতে আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়াতা’লা বলেছেন, প্রত্যেকটি প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে। মৃত্যু একটি এমনই মহাসত্য, যা একজন নাস্তিকও অস্বীকার করতে পারে না। উক্ত আয়াতে আরো উল্লেখিত হয়েছে যে, প্রত্যেকটি মানুষ তাদের কর্মফল উপভোগ করার জন্য মৃত্যুবরণ করবে এবং তাদের মাঝে কেউ জাহান্নামে যাবে এবং কেউ জান্নাতে প্রবেশ করার সৌভাগ্য লাভ করবে।

প্রতিটি জীবন মৃত্যুর আস্বাদ গ্রহণ করবে এবং ক্বিয়ামাতের দিন তোমাদেরকে পূর্ণমাত্রায় বিনিময় দেয়া হবে। যে ব্যক্তিকে জাহান্নামের আগুন হতে রক্ষা করা হল এবং জান্নাতে দাখিল করা হল, অবশ্যই সে ব্যক্তি সফলকাম হল, কেননা পার্থিব জীবন ছলনার বস্তু ছাড়া আর কিছুই নয়। 

আল্লাহ্‌ সুবহানাহু তায়ালা সূরা মূলকের দ্বিতীয় আয়াতে বলেছেন যে, আমাদের এই জীবন আসলে একটি পরীক্ষা ব্যতীত আর কিছুই না।

যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন- ‘আমলের দিক দিয়ে তোমাদের মধ্যে কোন্ ব্যক্তি সর্বোত্তম? তিনি (একদিকে যেমন) মহা শক্তিধর, (আবার অন্যদিকে) অতি ক্ষমাশীল।

যদি আমরা উপরোক্ত আয়াতটিকে একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি, তাহলে একটি বিষয় লক্ষ্য করা যাবে যে – আল্লাহ আমাদেরকে মৃত্যুকে সৃষ্টি করার কথা আগে বলেছেন এবং তারপর তিনি জীবন সৃষ্টি করার কথা বলেছেন। উক্ত আয়াতটি ইঙ্গিত করে যে মৃত্যু আমাদের জন্য পূর্বনির্ধারিত করা হয়েছে এবং এইভাবে জীবনের চাইতেও বেশি প্রাধান্য – মৃত্যুকে দেয়া হয়েছে । 

এই জীবন এক পরীক্ষা ক্ষেত্র

প্রকৃতপক্ষে, এই জীবন এক পরীক্ষা ক্ষেত্র ছাড়া আর কিছুই না এবং মানুষ যখন মারা যায় তখন তার পরীক্ষাও শেষ হয়ে যায়। সুতরাং, যেখানে মৃত্যুর মাধ্যমে একটি মানুষের পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়, সেখানে মৃত ব্যক্তির আত্মা এই পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ানোর যৌক্তিক আর কোন কারণ থাকে না। শেষ বিচারের দিনে সকলকেই পুনরুত্থিত করা হবে এবং সবার ফলাফল ঘোষণা করা হবে; এবং সেই বিচারের দিবসের মালিক হবেন স্বয়ং আল্লাহ- সুবহানু ওয়াতায়ালা। সেদিন আমাদের পরীক্ষার সময়কালীন (অর্থাৎ জীবনযাপনের) কৃতকর্মের উপর ভিত্তি করেই আমাদের পরিণতি নির্ধারণ করা হবে। সর্বপ্রথম মানুষ হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে – আমরা সহ – পৃথিবীতে বসবাসকারী শেষ মানুষ পর্যন্ত – সবার ক্ষেত্রেই এই একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে । 

শেষ বিচারের দিনে ন্যায়বিচারের নিরপেক্ষতা 

আল্লাহ্‌ তায়ালা কুরআনে বলেছেন যে শেষ বিচারের দিনে কারো সাথেই অন্যায় করা হবে না:

তোমরা সেদিনের ভয় কর, যেদিন তোমাদেরকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে নেয়া হবে। অতঃপর প্রত্যেক লোককে তার কৃতকর্মের বিনিময় দেয়া হবে এবং তারা কিছুমাত্র অত্যাচারিত হবে না। {সূরা আল-বাকারা: আয়াত ২৮১}

এই পৃথিবীতে আমাদের কর্মের একাধিক সাক্ষী আছে 

শেষ বিচারের দিনে আমাদের কৃতকর্মের একাধিক সাক্ষী উপস্থিত থাকবে, যা হয় আমাদের পক্ষে অথবা আমাদের বিপক্ষে সাক্ষী দিবে। এমনকি আমাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, চোখ, হাত ও পা ইত্যাদিও সেদিন সাক্ষ্য দিতে পারবে, সুতরাং সত্য থেকে কোনোভাবেই রেহাই পাওয়া যাবে না। আর এই বিষয়ে হয়তো আমরা সকলেই অবগত আছি যে, আমাদের সাথে দুইজন ফেরেশতা আছেন; যারা সার্বক্ষণিক আমাদের সমস্ত কার্যকলাপ লিপিবদ্ধ করে রাখছেন। 

যেদিন তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে তাদের জিহবা, তাদের হাত, তাদের পা- তাদের কৃতকর্মের ব্যাপারে।  {সূরা আন-নূর: আয়াত ২৪}

মৃত্যুর সময় এসে গেলে এই পরীক্ষার সময়ও শেষ হয়ে যায়

যখন মৃত্যুর সময় এসে যায়, তখন যদি কেউ আল্লাহর কাছে কাকুতি মিনতি করেও অনুরোধ করে, আমাকে শুধু আর একবার একটু সুযোগ দিন আমাকে  ভালো হওয়ার  জন্য আর নিজেকে সম্পূর্ণরূপে শুধরে নেবো। তখন তাদেরকে জানিয়ে দেওয়া হবে যে এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে – পরীক্ষার সময় শেষ। এই উদাহরণটি সূরা আল মুমিনূনে লিপিবদ্ধ করা আছে।

এমনকি যখন তাদের কারো কাছে মৃত্যু এসে হাজির হয় তখন সে বলে : ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে আবার (দুনিয়াতে) পাঠিয়ে দাও। যাতে আমি সৎ কাজ করতে পারি যা আমি করিনি। কক্ষনো না, এটা তো তার একটা কথার কথা মাত্র। তাদের সামনে পর্দা থাকবে পুনরুত্থানের দিন পর্যন্ত। {সূরা আল-মুমিনুন: আয়াত ৯৯-১০০}

একজন মানুষ মারা গেলে আসলে কি হয়?

ইসলামে কুসংস্কার নিষিদ্ধ শুধুমাত্র কুরআন ও সহীহ হাদীস হলো গায়েবী বিষয়গুলোর গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা 

কেউ মারা যাওয়ার পরে তার আত্মার কি হয়? এই প্রশ্নের উত্তরটি মূলত আধ্যাত্মিক জগতের সাথে সম্পর্কিত। আধ্যাত্মিক বা গায়েবী বিষয়গুলো বলতে সেই সমস্ত বিষয়গুলোকে বুঝায়, যা মানুষের পাঁচ ইন্দ্রিয় (দেখা, শোনা, স্পর্শ, গন্ধ বা স্বাদ নেওয়া) দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না অথবা বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণও করা যায় না। এই সমস্ত ব্যাপারগুলোতে, একমাত্র গ্রহণযোগ্য উৎস হলো সহীহ হাদিস এবং কুরআনের বাণী। আমাদের নিজেদের ভুল ধারণা ও কুসংস্কার এড়াতে এই দুইটি উৎসের বাহিরে অন্য যেকোনো উৎসের উপর নির্ভরশীল হওয়া আমাদের  কখনই উচিত না এবং ইসলামিক দৃষ্টিতেও তা নিষিদ্ধ। 

রূহ বা আত্মা কি?

এই বিষয়টি বুঝতে হলে, আমাদের সবার আগে আত্মা সম্পর্কিত কিছু বিষয় ভালো করে জেনে নিতে হবে। আসলে, আত্মা সম্পর্কিত জ্ঞান হচ্ছে এমন একটি ব্যাপার, যা মূলত আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাই ভালো জানেন। এই বিষয়টি আয়ত্ত্ব করার মতো যথেষ্ট জ্ঞান তিঁনি গোটা মানব জাতিকে প্রদান করেন নাই। 

তোমাকে তারা রূহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বল, ‘রূহ হচ্ছে আমার প্রতিপালকের হুকুমের অন্তর্ভুক্ত (একটি হুকুম)। এ সম্পর্কে তোমাকে অতি সামান্য জ্ঞানই দেয়া হয়েছে।’ {সূরা আল-ইসরা: আয়াত ৮৫}

আদম আঃ সাঃ এর রূহ

কুরআনের মাধ্যমে আল্লাহ আমাদেরকে জানিয়েছেন যে, তিনি আদম আঃ সাঃ এর শরীরে রূহ/আত্মা ফুঁকে দিয়েছেন। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদেরকে বেশ ভালোভাবে বুঝতে হবে যে, আল্লাহ্‌ “আমার আত্মা” শব্দটি ব্যবহারের মাধ্যমে আক্ষরিক অর্থে আদমকে স্বয়ং আল্লাহর আত্মা/রূহ ফুঁকে দেয়াকে বুঝায়নি। আল্লাহ এই শব্দটির মাধ্যমে আমাদেরকে `বুঝাতে চেয়েছেন যে তিঁনি তাঁর সকল সৃষ্টির মধ্যে আদমের আত্মা – এই সৃষ্টিটিকে একটি সম্মানজনক সৃষ্টি হিসেবে গণ্য করে এমন অভিব্যক্তি ব্যবহার করেছেন। সুতরাং, এমনটা ভাবার কোন যৌক্তিক কারণ নেই যে, আল্লাহর স্বর্গীয় সত্ত্বা আদমের আঃ সাঃ এর মধ্যে উপস্থিত ছিল বা তার পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেও উপস্থিত আছে – এটি একটি সম্পূর্ণ ভূল ধারনা।

আমি যখন তাকে পূর্ণ মাত্রায় বানিয়ে দেব আর তাতে আমার পক্ষ হতে রূহ ফুঁকে দেব, তখন তোমরা তার প্রতি সাজদায় পড়ে যেও।  {সূরা আল-হিজর: আয়াত ২৯}

ইবনে কাসির রহমতুল্লাহ উল্লেখ করেছেন, আল্লাহ্‌ আদম আঃ সাঃ এর মধ্যে রূহ ফুঁকে দিয়েছেন। আত্মা আদমের মাথার উপর থেকে শুরু করে পা পর্যন্ত রূহ ফুঁকেছিলেন। যখন এই আত্মা তার চোখ অবধি পৌঁছাল, তখন তিনি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখেছিলেন যে, এক (ইবলিশ) ব্যতীত অন্য সব ফেরেশতাই তার দিকে সেজদা রত অবস্থায় ছিল। রূহ যখন তার নাক অবধি পৌঁছাল তখন আদম হাঁচি দিয়েছিল। সাথে সাথে আদম আঃ সাঃ বলেছিলেন, আলহামদুলিল্লাহ (সমস্ত প্রশংসা ও ধন্যবাদ শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য)। জবাবে আল্লাহ্‌ তাকে বলেছিলেন, ইয়ারহামুকাল্লাহ (তোমার রব তোমার উপর রহমত প্রদর্শন করেছেন)। এটিই ছিল আল্লাহ্‌ এবং মানবজাতির মাঝে প্রথম কথোপকথন।

বাকি সব মানুষের রূহ

আল্লাহ্‌ সুবহানাহু তায়ালা আদম (আঃ) এর পিঠ ঘষে পৃথিবীতে অতীত, বিদ্যমান ও আগত প্রতিটি মানুষের আত্মাকে হাজির করেছিলেন। আমরা সহ, আদম (আঃ) এর সকল বংশধর সেদিন আল্লাহর (সুবহানাহু তায়ালার) সম্মুক্ষে অঙ্গীকার করে সাক্ষ্য দিয়েছিলাম যে, আল্লাহ্‌ ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই। আমাদের অঙ্গীকার নেওয়ার পর আল্লাহ্‌ (সুবহানাহু তায়ালা) বলেছিলেন, আশা করি শেষ বিচারের দিনেও এই একই সাক্ষ্য আমরা দিতে পারবো। কিন্তু আমরা আসলে এই ঘটনাটি ভুলে গিয়েছি: 

সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌ নাযিল করেছেন: স্মরণ কর, যখন তোমার প্রতিপালক আদম সন্তানদের পৃষ্ঠ হতে তাদের বংশধরদের বের করলেন আর তাদেরকেই সাক্ষী বানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই?’ তারা বলল, ‘হ্যাঁ; এ ব্যাপারে আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি।’ (এটা এজন্য করা হয়েছিল) যাতে তোমরা ক্বিয়ামাতের দিন না বল যে, ‘এ সম্পর্কে আমরা একেবারেই বে-খবর ছিলাম’। {সূরা আল-আরাফ: আয়াত ১৭২-৪}

আমাদের সকলের আত্মাগুলো, প্রথম থেকে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজম্নের, এই সকল আত্মাকে অনেক আগে থেকেই একইসাথে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাদের জন্মের সময় ঘনিয়ে এলে এই রূহগুলোকে পৃথিবীতে পাঠানো হয় এবং ফেরেশতারা তাদের মাতৃগর্ভে রূহটি ফুঁকে দেয়।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হইতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেছেন যে, তোমাদের সকলেই তার মায়ের গর্ভে সৃষ্টির চল্লিশদিন পর্যন্ত (জমাট বাঁধা) শুক্রাণু রূপে সমন্বিত হতে থাকে, তারপর রক্তপিন্ডরূপে চল্লিশদিন বিদ্যমান থাকে, তারপর অনুরূপ দিনে গোশতপিন্ডের রূপ ধারণ করে। তারপর আল্লাহ তা‘আলা তার নিকট একজন ফেরেশতা প্রেরণ করেন এবং তার মধ্যে রূহ্ সঞ্চার করেন। … {৪০ হাদিস নাওয়াবী: হাদিস নং ৪} {জামি আত-তিরমিযী, হাদিস নং ২১৩৭}

আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি  তখন আমাদের আত্মার কি হয়?

ঘুমানোর পর আমাদের আত্মা সাময়িকভাবে আমাদের শরীর থেকে বেরিয়ে যায় – তবে ঐ অবস্থায় আমাদের আত্মার সাথে আমাদের শরীরের কিছু সংযোগ তখনো থেকে যায়। কুরআন এবং হাদিসে এই সম্পর্কিত অনেক সহীহ তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়। ইমাম বাজ্জার তার মুসনাদ – কাশফুল অসতারে উল্লেখ করেছেন যে, নবী (সাঃ) বলেছেন, “ঘুম হচ্ছে মৃত্যুর ভাই।”

নিম্নে উল্লেখিত আয়াতে আল্লাহ আমাদেরকে জানিয়েছেন যে, যখন আমরা ঘুমাই বা মারা যাই, এই উভয় পরিস্থিতিতেই তিনি আমাদের কাছ থেকে আমাদের আত্মা নিয়ে নেন। যদি তিনি চান আমরা ঘুমন্ত অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করি – তাহলে তিনি আত্মাটিকে নিজের কাছে রেখে দেন। অন্যথায় তিনি আমাদের আত্মা আমাদেরকে ফিরিয়ে দিয়ে আমাদেরকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেন। 

আল্লাহ প্রাণ গ্রহণ করেন সেগুলোর মৃত্যুর সময়, আর যারা মরেনি তাদের নিদ্রাকালে। অতঃপর যার মৃত্যুর সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে তার (প্রাণ) রেখে দেন, আর অন্যগুলো একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ফিরিয়ে দেন। যারা চিন্তা গবেষণা করে তাদের জন্য এতে বহু নিদর্শন আছে।  {সূরা আয-যুমার: আয়াত ৪২}

এবং আল্লাহ সুবহানু ওয়াতালা আরো উল্লেখ করেছেন:

তিনিই রাত্রিকালে তোমাদের আত্মাকে নিয়ে নেন, আর দিনের বেলা যা তোমরা কর তা তিনি জানেন। অতঃপর দিনের বেলা তিনি তোমাদের জাগিয়ে দেন, যাতে জীবনের নির্দিষ্টকাল পূর্ণ হয়। অতঃপর তাঁর পানেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন, অতঃপর তিনি তোমাদের নিকট বর্ণনা করে দেবেন যা তোমরা করছিলে। {সূরা আল-আনআম: আয়াত ৬০}

একবার কিছু লোক ফজরের সময় ঘুম থেকে জেগে উঠতে পারেনি। তখন, আমাদের নবী (সাঃ) তাদেরকে বলেছিলেন যে, আল্লাহ্‌ তার ইচ্ছামাফিক সময় পর্যন্ত তোমাদের আত্মা তার কাছে রেখে দিয়েছিলেন, তাই তোমরা ঘুম থেকে উঠতে দেরি করেছো। 

যখন তাঁরা সালাত থেকে ঘুমিয়ে ছিলেন তখন নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছিলেন, “আল্লাহ্ যখন ইচ্ছা করেন তোমাদের রূহ্কে নিয়ে নেন, আর যখন ইচ্ছা ফিরিয়ে দেন।” ..“{আল-বুখারি: হাদিস ৭৪৭১}

বারা ইবনু ‘আযিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত:

বারা ইবনু ‘আযিব (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন শয্যাগ্রহণ করতেন তখন তিনি বলতেন, “আল্ল-হুম্মা বিস্মিকা  আহ্ইয়া- ওয়া বিস্মিকা  আমূতু” অর্থাৎ- “হে আল্লাহ! আমি তোমার নামেই জীবিত আছি আর তোমার নামেই মৃত্যুবরণ করছি।” আর যখত তিনি ঘুম হতে সজাগ হতেন তখন বলতেন, “আল্হাম্দু লিল্লা-হিল্লাযী আহ্ইয়া-না- বা‘দা মা- আমা-তানা- ওয়া ইলাইহিন্ নুশূর” অর্থাৎ- “সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্যই যিনি আমাদেরকে মৃত্যুবরণের পর জীবিত করছেন। আর তার দিকেই প্রত্যাবর্তন।”

{সহীহ মুসলিম: হাদিস নং ৬৭৮০}

এই আয়াত ও হাদিসগুলো দেখলে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, মৃত্যুর সাথে ঘুমের কিছুটা সামঞ্জস্য আছে এবং উভয় ক্ষেত্রেই আত্মা দেহ থেকে আলাদা করা হয়। তা সত্ত্বেও, ইবনে রজব (রহঃ) বলেছেন, ঘুমের সময় আত্মা সম্পূর্ণরূপে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয় না; বরং ঘুমের সময়ও আত্মা শরীরের সাথে সংযুক্তই থাকে। তবে সেই সংযোগটি অবশ্যই, জেগে থাকা সময়ের তার তুলনায় অনেকটাই হালকা থাকে। সুতরাং, শরীর থেকে আত্মা বহুবার প্রস্থান করে, কিন্তু শরীরে থেকে আত্মার বিচ্ছেদের ধরন অনুসারে নির্ভর করে শরীরটি জাগ্রত, ঘুমন্ত নাকি মৃত। এইজন্যই, জান্নাত ও জাহান্নামে ঘুম বলতে কিছুই নেই। 

আমাদের মৃত্যু হলে আত্মার কি হয়? 

এখন আমরা বুঝলাম যে, কেউ মারা গেলে তার আত্মা চিরতরে দেহ ত্যাগ করে। তখন আত্মা বারযাখ নামে পরিচিত একটি অবস্থায় প্রবেশ করে।

একজন ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার আত্মা আল্লাহ্‌র (সুবহানাহু তায়ালা) কাছে ফিরে যায় এবং জীবিত এই দুনিয়ার থেকে সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন এক মাত্রায় সংরক্ষিত থাকে এবং অপেক্ষা করতে থাকে চূড়ান্ত বিচার দিবসের জন্য, এই অবস্থানটি বারযাখ নামে পরিচিত।

ঘুম এবং মৃত্যুর সময় আত্মা কি অবস্থায় থাকে?

ঘুমের সময়: আত্মা সাময়িকভাবে শরীরের সাথে কিছু সংযোগ বজায় রেখে প্রস্থান করে। 

মৃত্যুর পর: আত্মা স্থায়ীভাবে দেহ ত্যাগ করে এবং বিচারের দিনের জন্য অপেক্ষায় থাকে। 

একজন ব্যক্তির মৃত্যুর পর, আত্মা এই জীবিত পৃথিবী ত্যাগ করে এবং আমাদের কাছে সম্পূর্ণরূপে অপরিচিত, ভিন্ন একটি মাত্রায় বা জগতে সংরক্ষিত থেকে চূড়ান্ত বিচার দিবসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে, যা বারযাখ নামে পরিচিত। 

সুতরাং, আমাদের জীবনের আসলে ৩টি পর্যায় রয়েছে:
  1. জীবন – বেঁচে থাকা যা আমাদের জন্ম থেকে শুরু হয় এবং আমাদের মৃত্যু পর্যন্ত স্থায়ী হয়;
  2. আল-বারজাখ – যা মৃত্যু থেকে শুরু হয় এবং বিচারের দিনের শুরুতে শেষ হয়;
  3. পরকাল – আমাদের পুনরুত্থান থেকে শুরু হয় এবং বিচার দিবসের পরেও চলতে থাকে (জান্নাত, জাহান্নাম, ইত্যাদি এতে অন্তর্ভুক্ত)।

বারযাখ কি

বারযাখ হলো ইহকাল ও পরকালের মধ্যবর্তী একটি পর্যায় বা স্টেশন। এটি এই জীবন্ত পৃথিবীর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটি জগৎ বা ক্ষেত্র যা ব্যাখ্যা করা অনেক কঠিন। এটি একটি বিশেষ ধরনের জীবন যা পার্থিব জীবনের মতো নয়। আমাদের পক্ষে এই বাস্তবতাটি উপলব্ধি করা অসম্ভব।

বারযাখ হল মৃত্যু ও কিয়ামতের মধ্যবর্তী একটি সময়, যেখানে মানুষ বছরের পর বছর শেষ বিচার দিবস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকে। এটি এই জীবন এবং বিচারের দিনের এর মধ্যে একটি পর্যায়, যা পার্থিব জীবন এবং বিচার দিবস – এই দুইটি থেকেই সম্পূর্ণ আলাদা।

বারযাখ শুরু ও সমাপ্তি

তাই, একজন ব্যক্তির জন্য:-

বারযাখ শুরু হয়: যখন আত্মা শরীর স্থায়ীভাবে ত্যাগ করা শুরু করে; এবং

বারজাখ শেষ হয়: বিচার দিবসে, যখন সেই দিনটি শুরু করার জন্য শিঙায় ফুঁক দেওয়া হবে।

কুরআনে বারযাখ: জাগতিক উদাহরণ

আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) কুরআনে এই পৃথিবীর কিছু জিনিসের দৃষ্টান্ত দিয়ে বারযাখ শব্দটি ব্যবহার করেছেন যা আমাদেরকে এই জগৎটি বুঝতে কিছুটা সাহায্য করতে পারে। বারজাখ শব্দটি কুরআনে নোনা পানি এবং মিষ্টি পানি-এর (সামুদ্রিক পানি ও নদীর পানি) মধ্যে অন্তরায়-কে বুঝিয়েছে, একইভাবে দুটি সমুদ্র/মহাসাগরের মধ্যে অন্তরায়-কে বুঝাতে এই একই শব্দ ব্যাবহৃত হয়েছে।

আর তিনিই [একসঙ্গে] দুটি সমুদ্রকে ছেড়ে দিয়েছেন, একটি তাজা ও মিষ্টি এবং একটি নোনতা ও তিক্ত, এবং তিনি তাদের মধ্যে একটি বাধা (বারযাখ) স্থাপন করেছেন এবং বিভাজন নিষিদ্ধ করেছেন। {সূরা আল-ফুরকান: আয়াত ৫৩}

সূরা আর-রহমান-এ, আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) বলেছেন বায়না হুমা বারযাখুল্লা ইয়াবগিয়ান, মানে দুটি মহাসাগরের মধ্যে অন্তরায়। এটি দুইটি সমুদ্রের মধ্যে একটি অন্তরায়, যেখানে তারা মিশে না। এই একই শব্দ কুরআনে ব্যবহার করা হয়েছে, যেখানে আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) বলেছেন যে, যারা মারা গেছে, তাদের পরে একটি অন্তরায় বা বারযাখ রয়েছে যা মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে পুনরুত্থানের দিন পর্যন্ত চলতে থাকবে।

তিনি দুই সমুদ্রকে ছেড়ে দিলেন, [পাশাপাশি] মিলিত হলেন। তাদের মধ্যে একটি প্রতিবন্ধক (বারযাখ) [তাই] তাদের কেউই সীমালঙ্ঘন করে না। {সূরা আর-রহমান: আয়াত ১৯-২০}

কুরআনে বারজাখ: এই মেটা-ফিজিক্যাল ফর্ম-এর ডাইরেক্ট রেফারেন্স

এই বিশেষ পর্যায়টি এক ধরনের অন্তরায়, যা জীবনের সাথে কোনোভাবেই মিলে  না, আমরা জানি না যে তাদের সাথে কি ঘটছে এবং তারা জানে না যে আমাদের সাথে কি ঘটছে। এটি জীবন এবং বিচার দিনের মধ্যবর্তী একটি অস্থায়ী স্টেশন।

সূরা আল-মু’মিনুন আমাদেরকে এই বারযাখ সম্পর্কে শিক্ষা দেয়, নিম্ন বর্তিত আয়াতগুলি একজন কাফের এর একটি ঘটনা চিত্রায়িত করেছে, যখন সে বারযাখ এর পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। সেই সময়ে সে আল্লাহের কাছে মিনতি করছে যেন তাকে আবার পৃথিবীতে পাঠিয়ে একটু সময় দেওয়া হয় যেন সে কিছু ভালো কাজ করতে পারে, তখন তাকে প্রত্যাখিত করে বলা হবে যে তার বারযাখের সময় শুরু হতে যাচ্ছে।

যখন তাদের একজনের মৃত্যু আসে, তখন সে বলে, হে আমার পালনকর্তা, আমাকে ফেরত পাঠান, যাতে আমি যা রেখে গিয়েছিলাম তাতে সৎকর্ম করতে পারি। না! এটা একটা কথাই সে বলছে; এবং তাদের পিছনে রয়েছে বারযাখ(বাধা) যেদিন তারা পুনরুত্থিত হবে। {সূরা আল-মুমিনুন: আয়াত ৯৯-১০০}

ইনডাইরেক্ট রেফারেন্স

উপরের আয়াতটিতে মৃত্যুর পর বারযাখের ব্যাপারে ডাইরেক্ট রেফারেন্স দেওয়া হয়েছে। তবে, এই মেটা-ফিজিক্যাল দুনিয়াটির ইনডাইরেক্ট রেফারেন্সও কুরআনে অন্যান্য কিছু আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে। আমরা যদি সূরা আত-তাওবার, ১০১ নম্বর আয়াতটি একটু দেখি:

তোমাদের চতুষ্পার্শ্বে কতক বেদুঈন হল মুনাফিক, আর মাদীনাবাসীদের কেউ কেউ মুনাফিকীতে অনঢ়, তুমি তাদেরকে চেন না, আমি তাদেরকে চিনি, আমি তাদেরকে [দুনিয়ায়] দুবার শাস্তি দেব, (ক্ষুধা বা নিহত হওয়া এবং কবরের শাস্তি) অতঃপর তাদেরকে মহা শাস্তির পানে ফিরিয়ে আনা হবে।  {সূরা আত-তওবা: আয়াত ১০১}

এই আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়াতে দুবার শাস্তি দেবেন এবং তারপর জাহান্নামে পাঠাবেন। দুইবার – এই শব্দটি ইঙ্গিত করে: তারা প্রথমে জীবিত অবস্থায় এই দুনিয়ায় একবার শাস্তি পাবে এবং দ্বিতীয়বার বারযাখে এই দুনিয়াতেই তাদেরকে শাস্তি উপভোগ করানো হবে।

যেদিন তাদের ষড়যন্ত্র তাদের কোন কাজে আসবে না এবং তাদের সাহায্যও করা হবে না। আর যারা যুলুম করেছে তাদের জন্য আগেও রয়েছে শাস্তি, কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানে না। {সূরা আত-তুর: আয়াত ৪৬-৪৭}

ইনডাইরেক্ট রেফারেন্সগুলির মধ্যে সবচাইতে সুস্পষ্ট রেফারেন্স সূরা গাফির এর ৪৬ নং আয়াতে পাওয়া যায়, যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কিছু মৃত ব্যক্তিদেরকে বারযাখের দুনিয়ায় জাহান্নাম দেখানো হবে।

(ক্ববরে) তাদেরকে সকাল-সন্ধ্যায় জাহান্নামের সামনে উপস্থিত করা হয় আর যেদিন ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে সেদিন (বলা হবে) ফেরাউনের জাতি গোষ্ঠীকে কঠিন ‘আযাবে প্রবিষ্ট কর। {সূরা গাফির: আয়াত ৪৬}

বারযাখের দুনিয়ায় – সময়

বারযাখ দুনিয়ার সময়, এই পৃথিবীর সময়ের মতো নয়। বারযাখের দুনিয়ায় মুমিনদের সময় কাফেরদের সময়ের তুলনায় অন্যরকম হবে। একজন ভালো মানুষ যিনি হয়তো হাজার বছর আগে মারা গেছেন আর একজন খারাপ ব্যক্তি যে কিনা কিছুদিন আগে মৃত্যু বরণ করেছেন, সেই ভালো মানুষটির কাছে সেই খারাপ মানুষটির তুলনায় বারযাখে অপেক্ষার সময় অনেক কম অনুভব হতে পারে। সুতরাং, এই সময়টি সহজ হবে নাকি কঠিন হবে, তা নির্ভর করবে সেই মানুষদের জীবিত থাকাকালীন সময়ের কার্যকলাপের উপর।

বারযাখে আত্মার যাত্রা

আত্মার যাত্রার বিখ্যাত হাদিস

আল-বারা’ ইবনে আযিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত বিখ্যাত হাদীসটি মৃত্যুর পর আত্মার প্রথম যাত্রাপথ নিয়ে আলোচনার মৌলিক হাদীস। পরবর্তী অংশে আমরা এই হাদীসটির সাথে আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আরো দুইটি হাদীস নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করবো: প্রথম হাদীসটি ইবনে মাজাহ এবং দ্বিতীয়টি আল-নাসায়ী -তে উল্লেখিত হয়েছে।  এই তিনটি হাদীসের সংমিশ্রণে আমরা জানতে পেরেছি যে কেউ মারা গেলে আসলে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো ঘটে:

বিশ্বাসী আত্মার জন্য

যদি সেই ব্যক্তিটি একজন মুমিন হয়ে থাকে, তাহলে:

  • রূহ কবোজ করার আগে, ফেরেশতারা তাকে আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টির সুসংবাদ দেয়। একই কথা সূরা ফুসসিলাত আয়াত ৩০ এও সচিত্রিত করা হয়েছে

নিশ্চয় যারা বলে, ‘আল্লাহই আমাদের রব’ অতঃপর অবিচল থাকে, ফেরেশতারা তাদের কাছে নাযিল হয় (এবং বলে,) ‘তোমরা ভয় পেয়ো না, দুশ্চিন্তা করো না এবং সেই জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর তোমাদেরকে যার ওয়াদা দেয়া হয়েছিল’

  • জগ থেকে পানি ঢালার মতো মসৃণভাবে রূহ বের হয়ে আসে
  • তারপর ফেরেশতারা স্বর্গ থেকে আগত একটি সুগন্ধি কাপড়ে আত্মাটিকে মুড়ে নেয় 
  • তারপর ফেরেশতারা রুহটিকে নিয়ে রহমতের সাথে উপর দিকে উঠে যায়, 
  • যাত্রা পথে অন্যান্য ফেরেশতারা জিজ্ঞাসা করে – “এই বরকতময় আত্মাটি কে?” আত্মাটিকে সম্মানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়
  • যখন ফেরেশতারা আত্মাটিকে নিয়ে পরবর্তী সর্বনিম্ন আসমানে পৌঁছায় – আরও এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি চাওয়া হয় – অনুমতি দেওয়া হয়
  • একই ঘটনা ঘটে যখন তারা পরবর্তী আসমান গুলো পার হয় – এভাবে রুহটি সপ্তম আসমান অতিক্রম করে
  • অন্য আরেকটি হাদিসে উল্লেখ আছে, যে আত্মাটির অন্যান্য আত্মাদের সাথে দেখা হয় এবং তাদের মাঝে কিছু কথোপকথন হয়
  • আত্মাটি উচ্চতম আসমানে পৌঁছে যায়
  • তারপর আল্লাহ বলেন: “আমার বান্দার (আত্মার) নাম ই’ল্লিঈনে (নেককার লোকদের তালিকায়) লিপিবদ্ধ করো এবং আত্মাটিকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাও
  • তারপর আত্মাটিকে শান্তির সাথে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হয়, যেখানে তার জাসাদ (তার দেহের অবশিষ্টাংশ) আছে
  • আত্মাটি তার নিকটাত্মীয়দের পদধ্বনি শুনতে পায় – যখন তারা দাফনের পর কবর থেকে দূরে চলে যেতে থাকে
  • তারপর সেই ব্যক্তিটিকে উঠিয়ে বসানো হয় (বারযাখের দুনিয়ায় – শারীরিকভাবে এই পৃথিবীতে নয়) – কবরের প্রশ্নগুলো করার জন্য
  • মুনকার ও নাকির নামে দুইজন ফেরেশতা তাকে ৪টি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে – সে সফলভাবে সেইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে
  • কবরের ভিতরে চাপ দেওয়া হয় (এই বিষয়টি ভালো আত্মাদের জন্যেও প্রযোজ্য)
  • কবরটিকে প্রশস্ত এবং আলোকিত করা হয়
  • তার ভাল কাজগুলি একজন প্রশান্ত ব্যক্তির রূপে তার সাথে দেখা করে
  • তাকে জাহান্নাম দেখানো হয় (যেখান থেকে তিনি রক্ষা পেয়েছে) – তারপর তাকে জান্নাত দেখানো হয় (যা তার চূড়ান্ত গন্তব্য হতে চলেছে)।
অবিশ্বাসী আত্মার জন্য:

কিন্তু যদি সেই ব্যক্তিটি অবিশ্বাসী আত্মা হয়, তাহলে: 

  • রুহ কবজ করার আগে, ফেরেশতারা জাহান্নাম ও আল্লাহর গজবের দুঃসংবাদ দেয়
  • আত্মাটি বের হতে চায় না এবং জোর করে বের করা হয় – যেভাবে লোহার চিরুনির ভেতর থেকে ভেজা তুলা টেনে বের করলে অনুভব করা যায় 
  • তারপর ফেরেশতারা জাহান্নাম থেকে আগত একটি দুর্গন্ধযুক্ত কাপড়ে আত্মাটিকে মুড়ে নেয় 
  • তারপর ফেরেশতারা অভিশপ্ত এবং অপমানিত অবস্থায় আত্মাটিকে নিয়ে উপরে যায় – যেটি ভীত অবস্থায় থাকে
  • যাত্রা পথে অন্যান্য ফেরেশতারা জিজ্ঞাসা করে – “এই নোংরা আত্মাটি কে?” আত্মাটিকে অসম্মানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়
  • যখন আত্মাটিকে নিয়ে নিম্নতম আসমানে নিচে পৌঁছায় – আরও এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি চাওয়া হয় – অনুমতি প্রত্যাখ্যান করা হয়
  • আত্মার নাম সিজ্জীঈ’নে (খারাপ লোকদের তালিকায়) লিপিবদ্ধ করা হয়
  • তারপর আত্মাটিকে নীচে পৃথিবীতে ছুঁড়ে ফেলা হয়, যেখানে তার জাসাদ (তার দেহের অবশিষ্টাংশ) আছে
  • তারপর সেই ব্যক্তিটিকে উঠিয়ে বসানো হয় (বারযাখের দুনিয়ায় – শারীরিকভাবে এই পৃথিবীতে নয়) – কবরের প্রশ্নগুলো করার জন্য
  • মুনকার ও নাকির নামে দুইজন ফেরেশতা তাকে ৩টি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে – সে দুর্ভাগ্যক্রমে সেইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়
  • কবরের ভিতরে চাপ দেওয়া হয়
  • কবরটিকে সংকুচিত এবং অন্ধকার করা হয়
  • তার খারাপ কাজগুলি একজন ভয়ংকর ব্যক্তির রূপে তার সাথে দেখা করে
  • তাকে জান্নাত দেখানো হয় (যেখানে তিনি যেতে পারতেন) – তারপর তাকে জাহান্নাম দেখানো হয় এবং তা জোর করে চোখে ধরে রাখা হয় (যা হবে তার চূড়ান্ত গন্তব্য)।
প্রথম হাদিস: আল-বারা’ ইবনে আযিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত ইমাম আহমাদের বিখ্যাত হাদিস

আহমাদ (সহিহ হাদিসে কুদসি: হাদিস ৬৬) ও আবু দাউদ (৪৭৫৩) তে উল্লেখিত আল-বারা’ ইবনে আযিব (রাঃ) বলেছেন: আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে আনসার গোত্রের এক ব্যক্তির জানাযায় শরীক হওয়ার জন্য রওনা দিয়ে তার কবরের নিকট গেলাম। কিন্তু তখনও কবর খনন শেষ হয়নি। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বসলেন এবং আমরাও তাঁর চারিদিকে নীরবে তাঁকে ঘিরে বসে পড়লাম, যেন আমাদের মাথার উপর পাখি বসে আছে (এতটাই নিরবে ও শান্ত ভাবে বসেছিলাম)। তখন তাঁর হাতে ছিলো একখানা লাঠি, তা দিয়ে তিনি মাটিতে আঁচড় কাটছিলেন।

অতঃপর মাথা উঠিয়ে বললেনঃ “তোমরা আল্লাহর নিকট কবরের আযাব থেকে পানাহ চাও, দুইবার অথবা তিনবার (বললেন)”। অতঃপর বললেনঃ 

একজন মুমিনের জন্য

“নিশ্চয় মুমিন বান্দা যখন দুনিয়া প্রস্থান ও আখেরাতে পা রাখার সন্ধিক্ষণে উপস্থিত হয় তার নিকট আসমান থেকে সাদা চেহারার ফেরেশতাগণ অবতরণ করেন, যেন তাদের চেহারা সূর্য। তাদের সাথে জান্নাতের কাফন ও জান্নাতের সুগন্ধি থাকে, অবশেষে তারা তার দৃষ্টির সীমানা পর্যন্ত বসে যায়।

অতঃপর মালাকুল মউত আ: সা: এসে তার মাথার নিকট বসেন, তিনি বলেনঃ হে পবিত্র রুহ তুমি আল্লাহর মাগফেরাত ও সন্তুষ্টির প্রতি বের হও”। তিনি বললেনঃ “ফলে রুহ বের হয় যেমন মটকা/কলসি থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। তিনি তা গ্রহণ করেন, যখন গ্রহণ করেন চোখের পলক পরিমাণ তিনি নিজ হাতে না রেখে তৎক্ষণাৎ তা সঙ্গে নিয়ে আসা কাফন ও সুগন্ধির মধ্যে রাখেন, তার থেকে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ঘ্রাণ বের হয় যা দুনিয়াতে পাওয়া যায়”।

তিনি বললেনঃ “অতঃপর তাকে নিয়ে তারা ওপরে ওঠে, তারা যখনই অতিক্রম করে তাকে সহ ফেরেশতাদের কোন দলের কাছ দিয়ে তখনই তারা বলে, এ পবিত্র রুহ কে? তারা বলেঃ অমুকের সন্তান অমুক, সবচেয়ে সুন্দর নামে ডাকে যে নামে দুনিয়াতে তাকে ডাকা হত।

তাকে নিয়ে তারা দুনিয়ার আসমানে পৌঁছে, তার জন্য তারা আসমানের দরজা খোলার অনুরোধ করেন, তাদের জন্য দরজা খুলে দেয়া হয়, তাকে প্রত্যেক আসমানের নিকটবর্তীরা পরবর্তী আসমানে অভ্যর্থনা জানিয়ে পৌঁছে দেয়, এভাবে তাকে সপ্তম আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়। 

অতঃপর আল্লাহ বলেনঃ আমার বান্দার দফতর ইল্লিয়্যিনে লিখ এবং তাকে জমিনে ফিরিয়ে দাও, কারণ আমি তা (মাটি) থেকে তাদেরকে সৃষ্টি করেছি, সেখানে তাদেরকে ফেরৎ দেব এবং সেখান থেকেই তাদেরকে পুনরায় উঠাব”।

তিনি (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “অতঃপর তার রুহ তার শরীরে ফিরিয়ে দেয়া হয়, এবং মৃত ব্যক্তি তাদের (মৃত ব্যক্তির নিকট আত্মীয়-স্বজন কবর দেওয়ার পর যখন ফিরে  যেতে থাকে) জুতার শব্দ শুনতে পায়।

এরপর তার নিকট দু’জন ফেরেশতা আসবে, তারা তাকে বসাবে অতঃপর বলবেঃ তোমার রব কে? সে বলবেঃ আল্লাহ। অতঃপর তারা বলবেঃ তোমার দ্বীন কি? সে বলবেঃ আমার দ্বীন ইসলাম। অতঃপর বলবেঃ এ ব্যক্তি কে যাকে তোমাদের মাঝে প্রেরণ করা হয়েছিল? সে বলবেঃ তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। অতঃপর তারা বলবেঃ কিভাবে জানলে? সে বলবেঃ আমি আল্লাহর কিতাব পড়েছি, তাতে ঈমান এনেছি ও তা সত্য জ্ঞান করেছি।

অতঃপর এক ঘোষণাকারী আসমানে ঘোষণা দিবেঃ আমার বান্দা সত্য বলেছে, অতএব তার জন্য জান্নাতের বিছানা বিছিয়ে দাও, তাকে জান্নাতের পোশাক পরিধান করাও এবং তার জন্য জান্নাতের দিকে একটি দরজা খুলে দাও। তিনি বলেনঃ ফলে তার কাছে জান্নাতের সুঘ্রাণ ও সুগন্ধি আসবে, তার জন্য তার দৃষ্টির সীমা পর্যন্ত তার কবর প্রশস্ত করে দেয়া হবে।

তিনি বলেনঃ তার নিকট সুদর্শন চেহারা, সুন্দর পোশাক ও সুঘ্রাণসহ এক ব্যক্তি আসবে, অতঃপর বলবেঃ সুসংবাদ গ্রহণ কর যা তোমাকে সন্তুষ্ট করবে তার, এটা তোমার সেদিন যার ওয়াদা করা হত। সে তাকে বলবেঃ তুমি কে, তোমার এমন চেহারা যে শুধু কল্যাণই নিয়ে আসে? সে বলবেঃ আমি তোমার নেক আমল।

সে বলবেঃ হে আমার রব, কিয়ামত কায়েম করুন, যেন আমি আমার পরিবার ও সম্পদের কাছে ফিরে যেতে পারি”।

একজন কাফেরের জন্য

তিনি বলেনঃ “আর কাফের বান্দা যখন দুনিয়া থেকে প্রস্থান ও আখেরাতে যাত্রার সন্ধিক্ষণে উপনীত হয়, তার নিকট আসমান থেকে কালো চেহারার ফেরেশতারা অবতরণ করে, তাদের সাথে থাকে ‘মুসুহ’ (মোটা-পুরু কাপড়), অতঃপর তারা তার নিকট বসে তার দৃষ্টির সীমানা পর্যন্ত। 

অতঃপর মালাকুল মউত আসেন ও তার মাথার কাছে বসেন। অতঃপর বলেনঃ হে খবিস নফস, আল্লাহর রাগ ও গজবের জন্য বের হও। তিনি বলেনঃ ফলে সে তার শরীরে ছড়িয়ে যায়, অতঃপর সে তাকে টেনে বের করে যেমন ভেজা উল থেকে (লোহার) সিক বের করা হয়। 

অতঃপর সে তা গ্রহণ করে, আর যখন সে তা গ্রহণ করে চোখের পলকের মুহূর্ত হাতে না রেখে ফেরেশতারা তা ঐ ‘মোটা-পুরু কাপড়ে রাখে, তার থেকে মৃত দেহের যত কঠিন দুর্গন্ধ দুনিয়াতে হতে পারে সে রকমের দুর্গন্ধ বের হয়।

অতঃপর তাকে নিয়ে তারা ওপরে উঠে, তাকেসহ তারা যখনই ফেরেশতাদের কোন দলের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে তখনই তারা বলে, এ খবিস রুহ কে? তারা বলেঃ অমুকের সন্তান অমুক, সবচেয়ে নিকৃষ্ট নাম ধরে যার মাধ্যমে তাকে দুনিয়াতে ডাকা হত। 

এভাবে তাকে নিয়ে দুনিয়ার আসমানে যাওয়া হয়, তার জন্য দরজা খুলতে বলা হয়, কিন্তু তার জন্য দরজা খোলা হবে না”। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তিলাওয়াত করেনঃ  “তাদের জন্য আসমানের দরজাসমূহ খোলা হবে না ‎এবং তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ না ‎উট সূঁচের ছিদ্রতে প্রবেশ করে” {সূরা আরাফঃ ৪০}

অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলবেনঃ তার আমলনামা জমিনে সর্বনিম্নে সিজ্জিনে লিখ। 

অতঃপর তার রুহ সজোরে নিক্ষেপ করা হয়। অতঃপর তিনি তিলাওয়াত করেনঃ  “আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে, সে যেন ‎আকাশ থেকে পড়ল। অতঃপর পাখি তাকে ছোঁ ‎‎মেরে নিয়ে গেল কিংবা  বাতাস তাকে দূরের কোন ‎জায়গায় নিক্ষেপ করল” {সূরা হজঃ ৩১} ‎তার রুহ তার শরীরে ফিরিয়ে দেয়া হয়। 

অতঃপর তার নিকট দু’জন ফেরেশতা আসে ও তাকে বসায়, তারা তাকে জিজ্ঞাসা করেঃ তোমার রব কে? সে বলেঃ হা হা আমি জানি না। অতঃপর তারা বলেঃ তোমার দ্বীন কি? সে বলেঃ হা হা আমি জানি না। অতঃপর তারা বলেঃ এ ব্যক্তি কে যাকে তোমাদের মাঝে প্রেরণ করা হয়েছিল? সে বলেঃ হা হা আমি জানি না। 

অতঃপর আসমান থেকে এক ঘোষণাকারী ঘোষণা করবে যে, সে মিথ্যা বলেছে, তার জন্য জাহান্নামের বিছানা বিছিয়ে দাও, তার দরজা জাহান্নামের দিকে খুলে দাও, ফলে তার নিকট তার তাপ ও বিষ আসবে এবং তার ওপর তার কবর সংকীর্ণ করা হবে যে, তার পাঁজরের হাড় একটির মধ্যে অপরটি ঢুকে যাবে।

বর্ণনাকারী জারির বর্ণিত হাদিসে রয়েছেঃ তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, অতঃপর তার জন্য এক অন্ধ ও বধির ফিরিশতাকে নিযুক্ত করা হয়, যার সঙ্গে একটি লোহার হাতুড়ি থাকবে, যদি এ দ্বারা পাহাড়কে আঘাত করা হয় তাহলে তা ধুলায় পরিণত হয়ে যাবে।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তারপর সে তাকে হাতুড়ি দিয়ে স্বজোরে আঘাত করতে থাকে, এতে সে বিকট শব্দে চিৎকার করতে থাকে। যা মানুষ ও জীন ছাড়া পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত সকল সৃষ্ট জীবই শুনতে পায়। আঘাতের ফলে সে মাটিতে মিশে যায়। তিনি বলেন, অতঃপর (শাস্তি অব্যাহত রাখার জন্য) পুনরায় তাতে রূহ ফেরত দেয়া হয়।

অতঃপর তার নিকট বীভৎস চেহারা, খারাপ পোশাক ও দুর্গন্ধসহ এক ব্যক্তি আসবে, সে তাকে বলবেঃ তুমি সুসংবাদ গ্রহণ কর, যা তোমাকে দুঃখ দিবে, এ হচ্ছে তোমার সে দিন যার ওয়াদা করা হত। সে বলবেঃ তুমি কে, তোমার এমন চেহারা যে কেবল অনিষ্টই নিয়ে আসে? সে বলবেঃ আমি তোমার খবিস আমল। সে বলবেঃ হে রব কিয়ামত কায়েম কর না”।

দ্বিতীয় হাদীস: ইবনে মাজাহ (৪২৬২) তে উল্লেখিত – আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত: 

নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ মৃত্যুর সময় মানুষের নিকট ফেরেশতা আগমন করেন। অতএব মুমূর্ষু ব্যক্তি উত্তম লোক হলে তারা বলেন, হে পবিত্র আত্মা! পবিত্র দেহ থেকে প্রশংসিত অবস্থায় বের হয়ে এসো এবং আল্লাহর রহমত ও সুঘ্রাণের সুসংবাদ গ্রহণ করো। তোমার রব তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট নন। রূহ বের হয়ে আসা পর্যন্ত তারা এভাবে আহবান জানাতে থাকে। অতঃপর রূহ বের হয়ে আসলে তারা তা নিয়ে আসমানে আরোহণ করেন। এ রূহের জন্যে আসমানের দরজা খুলে দেয়া হয়। জিজ্ঞেস করা হয়, সে কে? ফেরেশতাগণ বলেন, অমুক ব্যক্তি। তখন বলা হয়, পবিত্র আত্মাকে স্বাগতম, যা ছিল পবিত্র দেহে। প্রশংসিত অবস্থায় তুমি প্রবেশ করো। আল্লাহর রহমাত ও সুঘ্রানের সুসংবাদ গ্রহণ করো। তোমার রব তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট নন। তাকে অবিরতভাবে এ সংবাদ প্রদান করা হয় যাবত না তা মহামহিম আল্লাহ যে আসমানে অবস্থান করেন সেখানে পৌঁছে যায়। মুমূর্ষু ব্যক্তি পাপাচারী হলে ফেরেশতা বলেন, হে নিকৃষ্ট দেহের নিকৃষ্ট আত্মা! নিন্দিত অবস্থায় বের হয়ে আয় এবং উত্তপ্ত গরম পানি ও রক্ত-পুঁজের দুঃসংবাদ গ্রহণ কর এবং অনুরূপ বহু বিষাক্ত বস্তুর। রূহ বের হয়ে আসা পর্যন্ত তারা এভাবে আহবান জানাতে থাকেন। অতঃপর তারা রূহসহ উর্দ্ধাকাশে আরোহণ করেন। কিন্তু তার জন্য দরজা খোলা হয় না। জিজ্ঞেস করা হয়, এ ব্যক্তি কে? বলা হয়, অমুক। তখন বলা হয়, নিকৃষ্ট দেহের নিকৃষ্ট আত্মার জন্য নাই কোন সাদর সম্ভাষণ। তুই নিন্দিত অবস্থায় ফিরে যা। কারণ তোর জন্য আকাশের দ্বারসমূহ খোলা হবে না। অতঃপর একে আসমান থেকে ফিরিয়ে দেয়া হয় এবং তা কবরে ফিরে আসে। [তাহকীক আলবানীঃ সহীহ।]

অন্যান্য ভালো লোকদের সাথে সাক্ষাত

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, মু’মিন ব্যক্তি যখন মৃত্যুর সম্মুখীন হয় তখন তার কাছে একদল রহমতের ফেরেশতা সাদা রেশমী কাপড় নিয়ে এসে (তার) আত্মাকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকেন, “তুমি আল্লাহর তা’আলার রহমত এবং সন্তুষ্টির পানে বের হয়ে আস আল্লাহ তা’আলা তোমার উপর রুষ্ট নন; তুমি তাঁর উপর সন্তুষ্ট, তিনিও তোমার উপর সন্তুষ্ট। তখন আত্মা মেশকের সুঘ্রাণ অপেক্ষাও অধিক সুঘ্রান ছড়াতে ছড়াতে বের হয়ে আসে। যখন ফেরেশতাগণ সম্মানের খাতিরে আত্মাকে পর্যায়ক্রমে একজনের হাত থেকে অন্যজনের হাতে দিয়ে আসমানের দরজায় নিয়ে আসেন তখন তথাকার ফেরেশতাগণ বলতে থাকেন, “এ সুগন্ধি কত না উত্তম! যা তোমরা পৃথিবী থেকে নিয়ে আসলে। আর তাঁরা তাকে মু’মিনদের রুহসমূহের কাছে নিয়ে যান। তোমাদের কেউ প্রবাস থেকে আসলে তোমরা যেরূপ আনন্দিত হও, মু’মিনদের রূহও ঐ নবাগত রূহকে পেয়ে ততোধিক আনন্দিত হয়। মু’মিনদের রূহ নবাগত রূহকে জিজ্ঞাসা করে যে, অমুক ব্যক্তি দুনিয়াতে কি কাজ করেছে? অমুক ব্যক্তি দুনিয়াতে কি কাজ করেছে? তখন ফেরেশতারা বলেন, তার সম্পর্কে তোমরা কি জিজ্ঞাসা করবে? সে দুনিয়ার চিন্তা-ভাবনায় ছিল। যখন নবাগত রূহ বলেঃ সে কি তোমাদের কাছে আসেনি? তখন আসমানের ফেরেশতারা বলেনঃ তাকে তার বাসস্থান হাবিয়াতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

আর কাফির যখন তার মৃত্যুর সম্মুখীন হয় তখন তার কাছে আযাবের ফেরেশতারা চটের ছালা নিয়ে আগমন করে এবং আত্মাকে উদ্দেশ্য করে বলে থাকে, “তুমি আল্লাহ তা’আলার আযাবের পানে বের হয়ে আস, তুমিও আল্লাহ তা’আলার উপর অসন্তুষ্ট, আল্লাহ তা’আলাও তোমার উপর অসন্তুষ্ট।” তখন সে মুর্দারের দুর্গন্ধ থেকেও অধিকতর দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে বের হয়ে আসে। যখন ফেরেশতারা তাকে নিয়ে দুনিয়ার আসমানের দরজায় পৌছে তখন তথাকার ফেরেশতারা বলতে থাকেঃ এ কি দুর্গন্ধ! এরপর ফেরেশতারা তাকে কাফিরদের আত্মাসমূহের কাছে নিয়ে যায়। {সুনান আন-নাসায়ী, হাদিস নং ১৮৩৩}

আত্মা হয় কবরে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়া করে নাহলে নিরুৎসাহিত ও দুশ্চিন্তিত হয়

সহীহ আল বুখারিতে এবং সুনানে নাসায়ীতে বর্ণিত হয়েছে, আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেছেন

রাসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যখন কোন মৃত ব্যক্তিকে খাটিয়ায় রাখা হয় আর লোকজন তাকে কাঁধে বহন করে, যদি সে নেককার হয়, তবে সে বলতে থাকে, “আমাকে শীঘ্র পাঠাও, আমাকে শীঘ্র পাঠাও” আর যদি বদকার হয় তবে বলতে থাকে, “হায়! তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?” তার আওয়াজ মানুষ ব্যতীত অন্য সবাই শুনতে পায়। যদি মানুষ তা শুনতে পেত তবে অবশ্যই বেহুঁশ হয়ে পড়ত। {সুনান আন-নাসায়ী ১৯০৯}

কবরের প্রশ্ন

সহীহ আল-বুখারীতে হাদিস নং ১৩৭৪ এ আনাস ইব্‌নু মালিক (রাঃ) এবং সুনানে আবু দাউদ হাদিস নং ৪৭৫৩ এ আল-বারা ইবনে আজিব (রাঃ) বর্ণনা করেছেন: মৃত ব্যক্তিকে যখন তার কবরে রেখে তার সাথীরা / নিকট আত্মীয়রা দূরে চলে যেতে থাকে, মৃত ব্যক্তিটি তখন তাদের জুতা বা সেন্ডেলের খস খস আওয়াজ শুনতে পায়।

তারপর ২ জন ফেরেশতা তার কাছে আসেন, তাকে বসিয়ে দেন (আধিভৌতিক বারযাখের জগতে)।

জামে’ আত-তিরমিজি-এর ১০৭১ হাদিসে আবূ হুরাইরা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন:

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ মৃত লোককে বা তোমাদের কাউকে যখন কবরের মধ্যে রাখা হয় তখন কালো বর্ণের এবং নীল চোখ বিশিষ্ট দু’জন ফেরেশতা আসেন তার নিকট। তাদের মধ্যে একজনকে মুনকার এবং অন্য জনকে নাকীর বলা হয়। তারা মৃত ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করবে:

একজন মুমিনের ক্ষেত্রে:

প্রথম প্রশ্নঃ তোমার রব কে? 

উত্তরঃ তখন সে বলে, আমার রব আল্লাহ।   

দ্বিতীয় প্রশ্নঃ তোমার দ্বীন কি? 

উত্তরঃ সে বলে, আমার দ্বীন হলো ইসলাম। 

তৃতীয় প্রশ্নঃ এ লোকটি তোমাদের মধ্যে প্রেরিত হয়েছিলেন, তিনি কে? 

উত্তরঃ সে বলে, তিনি আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) 

চতুর্থ প্রশ্নঃ তুমি কি করে জানতে পারলে? 

উত্তরঃ সে বলে, আমি আল্লাহর কিতাব পড়েছি এবং তার প্রতি ঈমান এনেছি এবং সত্য বলে স্বীকার করেছি।

অতঃপর আকাশ হতে একজন ঘোষক ঘোষণা করেন, আমার বান্দা যথাযথ বলেছে। তখন তাঁকে বলা হবে, জাহান্নামে তোমার অবস্থান স্থলটির দিকে নযর কর, আল্লাহ্‌ তোমাকে তার বদলে জান্নাতের একটি অবস্থান স্থল দান করেছেন। তখন সে দুটি স্থলের দিকেই দৃষ্টি রেখে দেখবে। কাতাদা (রহঃ) বলেন, আমাদের নিকট বর্ণনা করা হয়েছে যে, সে ব্যক্তির জন্য তাঁর কবর প্রশস্ত করে দেয়া হবে। তার জন্য ঐখানে আলোর ব্যবস্থা করা হবে। তারপর সে লোককে বলা হবে, তুমি ঘুমিয়ে থাক। তখন সে বলবে, আমার পরিবার-পরিজনকে সুসংবাদ দেওয়ার জন্য আমি তাদের নিকট ফিরে যেতে চাই। তারা উভয়ে বলবেন, বাসর ঘরের বরের মত তুমি এখানে এমন গভীর ঘুম দাও, যাকে তার পরিবারের সবচাইতে প্রিয়জন ব্যতীত আর কোন ব্যক্তি জাগিয়ে তুলতে পারে না। অবশেষে আল্লাহ তা’আলা কিয়ামাতের দিন তাকে তার বিছানা হতে জাগিয়ে তুলবেন।

একজন কাফের এর ক্ষেত্রে:

প্রথম প্রশ্নঃ তোমার রব কে? 

উত্তরঃ হায়! আমি কিছুই জানি না।  

দ্বিতীয় প্রশ্নঃ তোমার দ্বীন কি? 

উত্তরঃ হায়! আমি কিছুই জানি না। 

তৃতীয় প্রশ্নঃ এ লোকটি তোমাদের মধ্যে প্রেরিত হয়েছিলেন, তিনি কে? 

উত্তরঃ হায়! আমি কিছুই জানি না।

তখন আকাশের দিক হতে একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা করেন, সে মিথ্যা বলেছে। তখন তাকে বলা হবে, তুমি না নিজে জেনেছ, না তিলাওয়াত করে শিখেছ। তারপর যমীনকে বলা হবে, একে চাপ দাও। সে ব্যক্তিকে এমন শক্ত করে যমীন চাপ দেবে যে, তার পাঁজরের হাড়গুলো পরস্পরের মাঝে ঢুকে পরবে। আর তাকে লোহার মুগুর দ্বারা এমনভাবে আঘাত করা হবে, যার ফলে সে এমন বিকট চিৎকার করে উঠবে যে, দু’ জাতি (মানুষ ও জ্বিন) ছাড়া তার আশপাশের সকলেই তা শুনতে পাবে। (কিয়ামাতের দিন) আল্লাহ তাকে তার এ বিছানা হতে উঠানো পর্যন্ত সে লোক আযাব পেতে থাকবে।

হাতুড়ি দিয়ে আঘাত (কাফের এর জন্য)

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ বান্দাকে যখন তার কবরে রাখা হয় এবং তাকে ‍পিছনে রেখে তার সাথীরা চলে যায় (এতটুকু দূরে যে,) তখনও সে তাদের জুতার শব্দ শুনতে পায়, এমন সময় তার নিকট দু’জন ফেরেশতা এসে তাকে বসিয়ে দেন। অতঃপর তাঁরা প্রশ্ন করেন, এই যে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! তাঁর সম্পর্কে তুমি কী বলতে? তখন সে বলবে, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রসূল। তখন তাঁকে বলা হবে, জাহান্নামে তোমার অবস্থানের জায়গাটি দেখে নাও, যার পরিবর্তে আল্লাহ্‌ তা’আলা তোমার জন্য জান্নাতে একটি স্থান নির্ধারিত করেছেন। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ তখন সে দু’টি স্থান একই সময় দেখতে পাবে। আর যারা ক্বাফির বা মুনাফিক, তারা বলবে, আমি জানি না। অন্য লোকেরা যা বলত আমিও তাই বলতাম। তখন তাকে বলা হবে, না তুমি নিজে জেনেছ, না তিলাওয়াত করে শিখেছ। অতঃপর তার দু’ কানের মাঝখানে লোহার মুগুর দিয়ে এমন জোরে মারা হবে, যাতে সে চিৎকার করে উঠবে, তার আশপাশের সবাই তা শুনতে পাবে মানুষ ও জ্বীন ছাড়া। {সহিহ আল-বুখারী, হাদীস নং ১৩৩৮}

কবরের চাপ

কবরের  মধ্যে প্রত্যেকটি মানুষকেই এক ধরনের চাপ আস্বাদন করতে হবে – মুমিনদের ক্ষেত্রেও এই নিয়মটি প্রযোজ্য। আমরা এই কথা জানতে পেরেছি সা’দ ইব্‌নু মু’আয (রাঃ) এর হাদিস থেকে। যার মৃত্যুতে কিনা আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠেছিল, তার ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে।

জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) – কে তিনি বলতে শুনেছেন যে সা’দ ইব্‌নু মু’আয (রাঃ) – এর মৃত্যুতে আল্লাহ্‌ তা’আলার আরশ কেঁপে উঠেছিল। … {সহীহ আল-বুখারি, হাদিস নং ৩৮০৩

ইব্‌ন উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, সেই ব্যক্তি যাঁর জন্য আরশ কেঁপে উঠেছিল এবং যাঁর জন্য আকাশের দ্বারসমূহ খুলে গিয়েছিল এবং যাঁর জানাযায় সত্তর হাজার ফিরিশতা উপস্থিত হয়েছিল তাঁর কবরও মিলিয়ে গিয়েছিল। অত:পর তা প্রশস্ত হয়ে গিয়েছিল। {সুনানে আন-নাসায়ী, হাদিস নং ২০৫৫}

কবরের শাস্তি বা আযাব গুনাহগারদের জন্য প্রযোজ্য হবে – যার সাথে কবরের প্রশ্ন, কবরের চাপ ইত্যাদির তুলনা হয়না। কবরের প্রশ্ন ও চাপ এগুলো আসলে শাস্তি নয়, এগুলো প্রত্যেকের জন্যই প্রযোজ্য, ঈমানদার ব্যক্তিরাও এগুলো কিছুটা অনুভব করবে। কবরের শাস্তি এইগুলোর তুলনায় অনেক বেশী ভয়ঙ্কর, খারাপ ও যন্ত্রণাদায়ক।

মানুষের ভালো ও খারাপ আমল একজন সঙ্গী হয়ে দেখা দিবে

আল-বারা’ ইবনে আযিব (রাঃ)-এর হাদিস অনুসারে, কবরের জিজ্ঞাসাবাদের পর, নিম্নবর্ণিত ঘটনা ঘটে:

একজন মুমিনের ক্ষেত্রে:

তার নিকট সুদর্শন চেহারা, সুন্দর পোশাক ও সুঘ্রাণসহ এক ব্যক্তি আসবে, অতঃপর বলবেঃ সুসংবাদ গ্রহণ কর যা তোমাকে সন্তুষ্ট করবে তার, এটা তোমার সেদিন যার ওয়াদা করা হত। সে তাকে বলবেঃ তুমি কে, তোমার এমন চেহারা যে শুধু কল্যাণই নিয়ে আসে? সে বলবেঃ আমি তোমার নেক আমল।

কাফেরদের ক্ষেত্রে:

তার নিকট বীভৎস চেহারা, খারাপ পোশাক ও দুর্গন্ধসহ এক ব্যক্তি আসবে, সে তাকে বলবেঃ তুমি সুসংবাদ গ্রহণ কর, যা তোমাকে দুঃখ দিবে, এ হচ্ছে তোমার সে দিন যার ওয়াদা করা হত। সে বলবেঃ তুমি কে, তোমার এমন চেহারা যে কেবল অনিষ্টই নিয়ে আসে? সে বলবেঃ আমি তোমার খবিস আমল। সে বলবেঃ হে রব কিয়ামত কায়েম কর না”।

জান্নাত ও জাহান্নাম দেখানো হয়

আল-বারা’বি’আযিব-এর হাদিস অনুসারে, উপরে উল্লেখিত ঘটনাগুলোর ঠিক পরেই যা ঘটে:

একজন মুমিনের ক্ষেত্রে:

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ … তখন তাঁকে বলা হবে, জাহান্নামে তোমার অবস্থানের জায়গাটি দেখে নাও, যার পরিবর্তে আল্লাহ্‌ তা’আলা তোমার জন্য জান্নাতে একটি স্থান নির্ধারিত করেছেন। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ তখন সে দু’টি স্থান একই সময় দেখতে পাবে। {সহিহ আল-বুখারী, হাদীস নং ১৩৩৮}

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ … মু’মিন বান্দা তখন বলে, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, তিনি আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রসূল। তখন তাকে বলা হয়, জাহান্নামে তুমি তোমার আসন দেখে নাও। আল্লাহ তা‘আলা তোমার এ আসনকে জান্নাতের আসনের দ্বারা পরিবর্তন করে দিয়েছেন। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ তখন সে তার উভয় আসন অবলোকন করে নেয়।  

বর্ণনাকারী কাতাদাহ্ (রহঃ) বলেন, আমাদের নিকট এ কথাও উল্লেখ করা হয়েছে যে, অতঃপর তার কবরকে (দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে) সত্তর হাত প্রশস্ত করে দেয়া হয় এবং সবুজ শ্যামল গাছের দ্বারা পরিপূর্ণ করে দেয়া হয় কিয়ামাত পর্যন্ত। {সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ৭১০৫}

একজন অবিশ্বাসীর ক্ষেত্রে:

কাফিরের জন্য, তার জন্য জাহান্নামের একটি দরজা খুলে দেওয়া হবে এবং তার কবর সংকুচিত করা হবে, যতক্ষণ না তার বুকের পাঁজর মিশে যাবে। তার জন্য জান্নাতের একটি দরজা খুলে তাকে জান্নাতে তার স্থান দেখানো হবে এবং তাকে বলা হবে, যদি তুমি হেদায়েত প্রাপ্ত হতে তবে এটি তোমার স্থান হত। তার জন্য জাহান্নামের একটি দরজা খুলে দেওয়া হবে যেন সে তার উত্তাপ ও ​​আযাব অনুভব করতে পারে। এটাই তার স্থান হবে যতক্ষণ না পর্যন্ত আল্লাহ তাকে পুনরুত্থিত করবেন।

সূরা গাফির এর ৪৬ নং আয়াতে পাওয়া যায়, যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কিছু মৃত ব্যক্তিদেরকে বারযাখের দুনিয়ায় জাহান্নাম দেখানো হবে।

(ক্ববরে) তাদেরকে সকাল-সন্ধ্যায় জাহান্নামের সামনে উপস্থিত করা হয় আর যেদিন ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে সেদিন (বলা হবে) ফেরাউনের জাতি গোষ্ঠীকে কঠিন ‘আযাবে প্রবিষ্ট কর। {সূরা গাফির: আয়াত ৪৬}

ভাল আত্মারা বিচার দিবস পর্যন্ত ঘুমাবে

আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি যে মুনকার আর নাকিরের প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেয়ার পর  নিম্নবর্ণিত ঘটনা ঘটে:

…তারপর সে ব্যক্তির কবর দৈর্ঘ্য-প্রস্থে সত্তর গজ করে প্রশস্ত করা হবে এবং তার জন্য এখানে আলোর ব্যবস্থা করা হবে। তারপর সে লোককে বলা হবে, তুমি ঘুমিয়ে থাক। তখন সে বলবে, আমার পরিবার-পরিজনকে সুসংবাদ দেওয়ার জন্য আমি তাদের নিকট ফিরে যেতে চাই। তারা উভয়ে বলবেন, বাসর ঘরের বরের মত তুমি এখানে এমন গভীর ঘুম দাও, যাকে তার পরিবারের সবচাইতে প্রিয়জন ব্যতীত আর কোন ব্যক্তি জাগিয়ে তুলতে পারে না। অবশেষে আল্লাহ তা’আলা কিয়ামাতের দিন তাকে তার বিছানা হতে জাগিয়ে তুলবেন।… {জামে’ আত-তিরমিজি-এর ১০৭১ হাদিস}

সুতরাং, হাদিসটি উল্লেখ করেছে যে একটি ভাল আত্মার জন্য কবর প্রসারিত হয় (উদাহরণস্বরূপ কবরকে ৭০ x ৭০ হাত প্রশস্ত করে দেয়া হয়) এবং সুগন্ধি ও ঐশ্বরিক আলোয় আলোকিত করা হয়।

তারপর তাকে শান্তিতে ঘুমাতে বলা হয়। তখন সে জিজ্ঞেস করে, আমি কি আমার পরিবারে কাছে ফিরে যেতে পারি? অন্তত তাদেরকে জানানোর জন্য যে আমি ভালো আছি ও নিরাপদে আছি।

আত্মাটিকে বিয়ের পর নতুন জামাই যেভাবে ঘুমায়, ঠিক সেভাবে ঘুমানোর কথা বলা হয়। বিয়ের রাতটি কেমন হওয়া উচিত তা বোধ হয় আপনারা বুঝতেই পারছেন। তারপর নতুন জামাই যেরকম শান্তিতে ও নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যায় একথা মনে করে যে তার প্রিয়তমা তাকে আবার সকালে জাগিয়ে তুলবে। এখানে উল্লেখযোগ্য লক্ষণীয় বিষয় হল যে, এই উদাহরণটি দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে সেই ঘুমটি কতটা শান্ত ও চিন্তামুক্ত হয়, যদিও এই ব্যাপারটি পুরুষ ও মহিলা উভয় লিঙ্গের জন্যই প্রযোজ্য। 

এইভাবে আত্মাটি অনেক শান্তিতে বিচার দিন পর্যন্ত ঘুমাতে থাকবে যতক্ষণ না পর্যন্ত তাকে বিচার দিবসে পুনরুত্থিত করা হবে। 

সূরা ইয়াসিন-এর ৫২ নম্বর আয়াতে একটি মুমিনের অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে যখন তাকে বিচার দিবসে পুনরুত্থিত হবে এবং সে বলবে:يَـٰوَيْلَنَا مَنۢ بَعَثَنَا مِن مَّرْقَدِنَا ۜ ۗ

তারা বলবেঃ হায়! দুর্ভোগ আমাদের! কে আমাদেরকে আমাদের নিদ্রাস্থল হতে উঠালো? দয়াময় (আল্লাহ) তো এরই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং রাসূলগণ সত্যই বলেছিলেন। {সূরা ইয়াসিন আয়াত ৫২}

কবর হল অন্ধকার এবং সংকীর্ণ একটি জায়গা

সাধারণ ভাবেই খারাপ মানুষদের জন্য কবর হল অন্ধকার এবং সংকীর্ণ একটি জায়গা। কিন্তু নীচের ঘটনাটি দেখলে আমরা বুঝতে পারবো যে কবরকে আলোকিত করা হতে পারে।

মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবন দশায় একজন বৃদ্ধ মহিলার ঘটনা আছে যিনি সম্ভবত একজন কালো মহিলা ছিলেন যিনি উম্ম মাহজান নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি মসজিদ পরিষ্কার করতেন। একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার অনুপস্থিতি অনুভব করলেন এবং তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন।  সাহাবায়ে কেরাম জবাব দিলেন যে তিনি আসলে ইন্তেকাল করেছেন।  সুতরাং, তিনি (সাঃ) বললেন, “আমাকে এই ব্যাপারে আগে জানানো হয়নি কেন?”।  আবু হুরায়রা রাঃ হয়তো সেই মহিলার মৃত্যুকে একটি তুচ্ছ ব্যাপার মনে করেছিল।  তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, আমাকে দেখাও তার কবর কোথায়!  যেখানে তিনি (সাঃ) দুআ করেছেন।  অতঃপর তিনি (সাঃ) আমাদের সাহাবাদেরকে জানালেন যে, “সত্যিই, এই কবরগুলি এর বাসিন্দাদের জন্য অন্ধকার আচ্ছন্ন ছিল এবং আল্লাহ তাদের জন্য এটিকে আলোকিত করেছেন কারণ আমি তাদের জন্য দুআ করেছি।”

আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

কালো এক পুরুষ বা এক মহিলা মসজিদে ঝাড়ু দিত। সে মারা গেল। কিন্তু নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার মৃত্যুর খবর জানতে পারেননি। একদা তার কথা উল্লেখ করে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এ লোকটির কি হল? সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! সে তো মারা গেছে। তিনি বললেনঃ তোমরা আমাকে জানাওনি কেন? সে ছিল এমন এমন বলে তাঁরা তার ঘটনা উল্লেখ করলেন। বর্ণনাকারী বলেন, তাঁরা তার মর্যাদাকে খাটো করে দেখলেন। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ আমাকে তার কবর দেখিয়ে দাও। বর্ণনাকারী বলেন, তখন তিনি তার কবরের কাছে আসলেন এবং তার জানাযার সালাত আদায় করলেন। {সহিহ আল-বুখারী, হাদিস নং ১৩৩৭}

কবরের আযাব 

দুইজন ইহুদি বুড়ো মহিলা একবার আয়শা (রাঃ) এর কাছে এসে কবরের আজাব সম্পর্কে কথা বলেছিলো। এই বিষয়ে একবার আয়শা (রাঃ) নবী (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, উত্তরে তিনি (সাঃ) নিশ্চিত করে বলেছিলেন যে কবরের আযাব আসলে সত্য। আয়েশা (রাঃ) সেদিনের পর থেকে লক্ষ্য করেছিলেন যে, মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর প্রতিটি সালাতের পর সর্বদা কবরের আযাব থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। 

আয়িশাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, একদা আমার কাছে মাদীনাহ্‌র দু’জন ইয়াহূদী বৃদ্ধা মহিলা আসলেন। তাঁরা আমাকে বললেন যে, ক্ববরবাসীদের তাদের ক্ববরে ‘আযাব দেয়া হয়ে থাকে। তখন আমি তাদের এ কথা মিথ্যা বলে জানালাম। আমার বিবেক তাদের কথাটিকে সত্য বলে সায় দিল না। তাঁরা দু’জন বেরিয়ে গেলেন। আর নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমার নিকটে এলেন। আমি তাঁকে বললাম : হে আল্লাহ্‌র রসূল! আমার নিকট দু’জন বৃদ্ধা এসেছিলেন। অতঃপর আমি তাঁকে তাদের কথা জানালাম। তখন তিনি বললেনঃ তারা দু’জন ঠিকই বলেছে। নিশ্চয়য়ই ক্ববরবাসীদেরকে এমন আযাব দেয়া হয়, যা সকল চতুষ্পদ জীবজন্তু শুনে থাকে। এরপর থেকে আমি তাঁকে সব সময় প্রতি সালাতে ক্ববরের ‘আযাব হতে আল্লাহ্‌র আশ্রয় প্রার্থনা করতে দেখেছি। {সহিহ আল-বুখারি হাদিস ৬৩৬৬}; {সুনানে নাসাঈ; হাদিস ১৩০৮}

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন যে সূরা মুলক মৃত্যুর পরে শাস্তি থেকে আমাদেরকে রক্ষা করবে:

আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ কুরআনের মধ্যে ত্রিশ আয়াত বিশিষ্ট একটি সূরা আছে যেটি কারো পক্ষে সুপারিশ করলে তাকে মাফ করে দেয়া হয়। এ সূরাটি হল তাবারাকাল্লাযী বিয়াদিহিল মুল্‌ক।  {জামে আত-তিরমিযী: হাদিস নং ২৮৯১}

খালিদ ইবনু মা‘দান (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ

তিনি বলেন, তোমরা মুক্তিদানকারী সূরা ‘আলিফ লাম মিম তানযীল’ (সূরা আস্ সাজদাহ্) পড়ো। কেননা নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ কথা আমার নিকট পৌঁছেছে যে, এক ব্যক্তি এ সূরা পড়ত, এছাড়া আর কোন সূরা পড়ত না। সে ছিল বড় পাপী মানুষ। এ সূরা তার ওপর ডানা মেলে বলতে থাকত, হে রব! তাকে মাফ করে দাও। কারণ সে আমাকে বেশি বেশি তিলাওয়াত করত। তাই আল্লাহ তা‘আলা তার ব্যাপারে এ সূরার সুপারিশ গ্রহণ করেন ও বলে দেন যে, তার প্রত্যেক গুনাহের বদলে একটি করে নেকী লিখে নাও। তার মর্যাদা বৃদ্ধি করো।

তিনি (রাবী) আরো বলেন, এ সূরা কবরে এর পাঠকের জন্য আল্লাহর নিকট নিবেদন করবে, হে আল্লাহ! আমি যদি তোমার কিতাবের অংশ হয়ে থাকি, তুমি তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করো। আর যদি আমি তোমার কিতাবের অংশ না হয়ে থাকি, আমাকে তোমার কিতাব হতে মুছে ফেলো। (অন্য বর্ণনায় আছে) তিনি বলেন, এ সূরা পাখীর রূপ ধারণ করে এর পাঠকারীর ওপর পাখা মেলে ধরবে ও তার জন্য সুপারিশ করবে। এর ফলে কবর ‘আযাব হতে হিফাযাত করা হবে। বর্ণনাকারী সূরা তাবা-রকাল্লাযী’ (মুল্‌ক) সম্পর্কেও এ একই বর্ণনা করেছেন। খালিদ এ সূরা দু’টি না পড়ে ঘুমাতেন না। {মিশকাতুল মাসাবিহ: হাদিস নং ২১৭৬}

কি কি কারণে কবরের আযাব হতে পারে?

আমরা কয়েকটি সুস্পষ্ট হাদিস থেকে জানতে পারি যে নিম্নে উল্লেখিত কারণের জন্য কবরের আযাব হতে পারে:

  • কুফর বা অবিশ্বাস
  • নিফাক বা দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন করে অন্তরের কুফুরকে গোপন করে ইসলাম পালন করা
  • প্রস্রাব থেকে নিজেকে পবিত্র না করা
  • নামীমা বা একের কথা ওপরের কাছে লাগিয়ে বেড়ানো
  • গীবাহ বা গীবত করা 
  • খিবর বা অহংকার করা 
  • যুদ্ধের ময়দানে চুরি করা 
  • ঋণগ্রস্থ অবস্থায় মৃত্যুবরণ
  • রিবা বা সুদ খাওয়া
  • মিথ্যা কথা বলা
  • জিনা করা
  • সময়মত নামায না পড়া

সুতরাং, এসব দেখে আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি যে, যেকোন প্রকার কবিরা বা বড়-গুনাহ কবরের আজাবের কারণ হতে পারে।

মৃত ব্যক্তি বিশেষ কিছু শব্দ ব্যতীত কিছুই শুনতে পায় না

এটাও একটি অদৃশ্যের বিষয় তাই এই ব্যাপারটির প্রত্যেকটি বিষয়বস্তু আমাদেরকে কুরআন ও সহীহ হাদীস থেকে বের করতে হবে। আগে থেকে বলে নেওয়া উচিত যে, ইসলামিক স্কলারদের মতে এই বিষয়টি নিয়ে অনেক মতবিরোধ রয়েছে। তবে কুরআন ও হাদীসের নজির অনুসারে সবচাইতে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হলো, আল্লাহ তাদের কিছু জিনিস শোনার অনুমতি দিয়েছেন এবং বাকি ব্যাপারগুলো শোনার অনুমতি তাদেরকে দেওয়া হয় না।

বেশীরভাগ স্কলারদের মতে, মৃত ব্যক্তিরা জীবিত ব্যক্তিদের কথা শুনতে পারে না কারণ আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) আমাদের কুরআনে এ সম্পর্কে অবহিত করেছেন:

এবং জীবিত ও মৃত সমান নয়। নিশ্চয়ই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা শোনান, কিন্তু আপনি কবরের লোকদের শোনাতে পারবেন না {সূরা ফাতির: আয়াত: ২২}


নিশ্চয় তুমি মৃতদেরকে শোনাতে পারবে না এবং বধিরদেরকেও ডাক শোনাতে পারবে না যখন তারা পিছু হটবে। ” {সূরা আল-নামল: আয়াত ৮০} {সূরা আর-রূম: আয়াত ৫২}।

এই আয়াতের ব্যাপারে আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, 

নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন যে, নিশ্চয়ই তারা এখন ভালভাবে জানতে (ও বুঝতে) পেরেছে যে, (কবর আযাব প্রসঙ্গে) আমি তাদের যা বলতাম তা বাস্তব। আল্লাহ্‌ তা’আলা ঘোষণা করেছেনঃ “আপনি (হে নবী !) নিশ্চিতই মৃতদের (কোন কথা) শোনাতে পারেন না” (সূরা আন-নামালঃ ৮০)।

{সহীহ আল-বুখারি ১৩৭১}

মৃত ব্যক্তিরা তাদের কাছের লোকদের পদধ্বনি শুনতে পারে

উপরে উল্লেখিত পরিস্থিতির কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। শুধুমাত্র কুরআন ও হাদীস দিয়ে আমাদেরকে ব্যতিক্রম বিষয়গুলো খুঁজে বের করতে হবে। নিম্নলিখিত হাদিস অনুসারে, আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) মৃত ব্যক্তিদের তার সঙ্গী-সাথীদের পদধ্বনি শোনার অনুমতি দিয়েছেন, যখন তারা তাদের দাফন করার পর ফিরে যেতে থাকে:

আনাস বিন মালিক বর্ণনা করেছেন:

আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ বান্দাকে যখন তার কবরে রাখা হয় এবং তার সাথীরা এতটুকু মাত্র দূরে যায় যে, সে তখনও তাদের জুতার আওয়াজ শুনতে পায়।…

{সহীহ আল-বুখারী, হাদীস নং ১৩৭৪}

সুনানে আবু দাউদ হাদীস নং ৪৭৫৩ তেও অনুরূপ উল্লেখ করা হয়েছে

এই ব্যাপারটি বোঝার জন্য, আমরা একটি রেডিওর উদাহরণ বিবেচনা করতে পারি। আমরা যখন কোনো একটি রেডিও স্টেশনের চ্যানেল এর সম্প্রচারের ফ্রিকোয়েন্সি টিউন করি, তখন শুধুমাত্র সেই চ্যানেলটিতে কী চলছে তাই শুনতে পাই। অন্য সব চ্যানেলে কি হচ্ছে না হচ্ছে, আমরা তখন কিন্তু সেগুলি শুনতে পাই না। হাদিসটি একটি অনুরূপ পরিস্থিতির অবস্থা বুঝায়, যেখানে আমরা ধরে নিতে পারি যে, মৃত ব্যক্তিদেরকে আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) শুধুমাত্র নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সির কিছু শব্দ শোনার অনুমতি দিয়েছেন।

যখন একজন ব্যক্তি মারা যায় তখন তার আমল বন্ধ হয়ে যায় – ৩টি জিনিস ব্যতীত

আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, নবী মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন,

মানুষের মৃত্যুর সাথে সাথে তার কাজ ছিন্ন (বাতিল) হয়ে যায়, কিন্তু তিনটি কাজের (সাওয়াব লাভ) বাতিল হয় নাঃ সাদকায়ে জারিয়া, এমন জ্ঞান যা দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় এবং এমন সন্তান যে তার জন্য দুআ করে। {সহীহ জামি’ আত-তিরমিযী; হাদিস নং ১৩৭৬}

সুতরাং, যখন একজন ব্যক্তি মারা যায়, তখন তার সমস্ত আমল বন্ধ হয়ে যায়, তিনটি জিনিস ছাড়া (যা বোনাস হিসেবে চলতে থাকে):

  1. সাদাকাহ জারিয়াহ (যেই দান থেকে চলমান উন্নতি/সেবা হতে থাকে, যেমন একটি মসজিদ নির্মাণ)।
  2. উপকারী জ্ঞান (যা রেখে যাওয়ার পরও অন্যরা তা থেকে উপকৃত হতে থাকে), এবং
  3. একটি ধার্মিক সন্তান যে তার জন্য দুআ/প্রার্থনা করে যাবে।”

সাদাকাহ জারিয়াহ

সাদাকাহ জারিয়াহ হলো এমন প্রকার দান যার ফলে ভবিষ্যতে ক্রমাগত উপকার পাওয়া যেতে পারে। সাদাকা এর অর্থ হলো দান করা আর জারিয়াহ এর অর্থ যা অব্যাহত থাকে। এই সকল দান-সাদাকা গুলো যিনি করবেন, সেই ব্যক্তির মৃত্যুর পরেও মানুষ, পশুপাখি ইত্যাদি সেই দান থেকে উপকারিতা পেতেই থাকবে।

সাদাকাহ জারিয়াহর উদাহরণ:

  1. দরিদ্র মানুষের জন্য একটি বিদ্যালয় নির্মাণ করা; অথবা
  2. মসজিদ নির্মাণ নির্মাণ করা বা  নির্মাণে অবদান রাখা।
  3. গরিব কোনো মানুষকে একটি জায়নামাজ অথবা পোশাক দান করা, যা সে হয়তো দাতার মৃত্যুর পরও ব্যবহার করে, তা থেকে উপকৃত হতে থাকবে। 

যতদিন মানুষ এগুলো ব্যবহার করে উপকৃত হতে থাকবে, ততদিন দাতা তার মৃত্যুর পরেও সেই দান থেকে সোয়াব পেতে থাকবে।

উপকারী জ্ঞান

অনেক উপকারী জ্ঞান আছে, যা সেই ব্যক্তির মৃত্যুর পরেও ছড়িয়ে পড়ে মানব জগতের উপকারে আসতে থাকে। এই হাদীসটি অনুযায়ী, মৃত্যুর পর বোনাস হিসাবে তার ভাল কাজের তালিকায় যোগ হতেই থাকবে। উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় হলো হাদীসটি, শুধুমাত্র ইসলামিক অথবা দ্বীনি জ্ঞানের মধ্যে এই বিষয়টিকে সীমাবদ্ধ করেনি।

উদাহরণ হিসেবে:

  1. একটি সমাবেশে প্রেরণামূলক বক্তৃতা;
  2. সহীহ তথ্যের ভিত্তিতে লেখা একটি ইসলামিক আর্টিকেল; অথবা
  3. কুরআনের কোনো আয়াত বা হাদীস এর অর্থ অথবা ইসলামিক কোনো আর্টিকেলযাচাই করে শেয়ার করাও উপকারী জ্ঞানের আওতাধীন হতে পারে।

এমন জ্ঞান যা একজন ব্যক্তি মানুষের মাঝে শেয়ার করে গিয়েছেন, তা যত মানুষ জানতে ও শিখতে থাকবে, সেই ব্যক্তি তার মৃত্যুর পরও ততোই এই কারণে সওয়াব পেতে থাকবে। 

একজন ধার্মিক সন্তানের প্রার্থনা/দুআ – মৃত ব্যক্তির জন্য

একজন ব্যক্তির জন্য সবচেয়ে মূল্যবান উপহার হলো তার একটি ধার্মিক সন্তান, যে কিনা সেই মৃত ব্যক্তির জন্য দুআ করতে থাকবে। অবশ্যই, অন্য ব্যক্তির দুআও মৃত্যুর পর সাহায্য করতে পারে, তবে সন্তানের দুআ মৃত ব্যক্তির জন্য সবচাইতে বেশী কার্যকর হয়, কারণ এটি প্রায় তার নিজের আমলের সমতুল্য ধরে নেওয়া হয়।

আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ এক কিনতার হলো বারো হাজার উকিয়ার সমান এবং উকিয়া হলো আসমান-যমিনের মাঝখানে যা কিছু আছে তার চেয়ে উত্তম। রাসূলু্ল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরও বলেনঃ জান্নাতে মানুষের মর্যাদা অবশ্যই বৃদ্ধি করা হবে। সে বলবে, এটা (মর্যাদা বৃদ্ধি) কীভাবে হলো? বলা হবে, তোমার জন্য তোমার সন্তানের ক্ষমা প্রার্থনার বদৌলতে।

{সুনান ইবনে মাজাহ ৩৬৬০}

অন্য মানুষের দুআ – মৃত ব্যক্তির জন্য

একজন ব্যক্তির মৃত্যুর সাথে সাথে তার সমস্ত নেক আমলের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। সেই ব্যক্তিটি মারা যাওয়ার পরও শুধু  ৩টি জিনিস সরাসরি তার আমলনামায় বোনাস হিসেবে যোগ হতে থাকে। অন্যান্য ব্যক্তির দুআ অবশ্যই সেই আত্মার উপকারে আসতে পারে তবে সেগুলি এই ৩টি জিনিসের সমতুল্য কখনোই হতে পারবে না।

বাকি অনিশ্চিত বিষয়সমূহ

এসব বিষয়ে, অনিশ্চিত আনুসঙ্গিক বিষয়সমূহের উপর আমাদের মনে অনেক প্রকার প্রশ্ন উদয় হতে পারে, যেগুলো সম্পর্কে কুরআন বা সহীহ হাদীসে কোনো উত্তর পাওয়া যায় না।

উদাহরণস্বরূপ, কেউ জিজ্ঞাসা করতে পারে:

  • আমরা জানি যে মৃত ব্যক্তিদেরকে কবর দিয়ে – যখন তার কাছের মানুষেরা ফিরে যেতে থাকে – তখন সেই মৃত ব্যক্তি তাদের পদধ্বনি শুনতে পায়। মৃত ব্যক্তি কি তাদেরকে দেখতেও পায়?
  • মৃত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের পূর্বে কবরে তাকে বসানো হবে। কবরে যদি বসানোর জন্য কোনো জায়গা না থাকে তাহলে কিভাবে তাকে বসানো সম্ভব?
  • মৃত্যুর পরে আত্মার সাথে শরীর কীভাবে শাস্তি অনুভব করবে?

আমাদের কাছে এই বিষয়গুলোর কোনো ব্যাখ্যা নেই। অদৃশ্যের কোনো জ্ঞানের ব্যাপারে, যেখানে কুরআন ও সহীহ হাদিসে কোন তথ্য পাওয়া যায় না, সেখানে আমাদের অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে আল্লাহু আ’লাম – অর্থাৎ, এই ব্যাপারে আল্লাহ(সুবহানাহু ওয়া তায়ালা)ই ভাল জানেন এবং আমাদেরকে সেখানেই আলোচনা থামিয়ে দিতে হবে। আমরা অদৃশ্যের যেকোনো তথ্যের ব্যাপারে এই দুটি উৎসের বাহিরে – কোনো কিছুই নিশ্চিত সত্য হিসেবে বিশ্বাস করতে পারি না – তা নাহলে আমরা কুসংস্কারের শিকার হয়ে যেতে পারি। আর ইসলামে কুসংস্কারের কোনোই অবকাশ নেই।

আমরা আমাদের মৃত প্রিয়জনের জন্য কি করতে পারি?

এটি সম্পূর্ণরূপে একটি ভুল ধারনা যে, প্রিয়জন বা কাছের মানুষের মৃত্যুতে কান্না করা বা কষ্ট পাওয়া ইসলাম সমর্থন করে না। এসব ব্যাপার শরীয়ত বিরোধী নয়, কারণ এসব বিষয়গুলো সম্পূর্ণ স্বাভাবিক আবেগের আওতাভূক্ত বলে ধরে নেওয়া হয়। 

আসমা বিনতে ইয়াযীদ (রাঃ) এর একটি হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি যে, যখন নবী (সাঃ) এর পুত্র ইব্রাহিম (আঃ) তার হাতে মারা গিয়েছিলো, তিনি (সাঃ) কান্না করেছিলেন। সাহাবারা সেই কান্না দেখে কিছুটা বিস্মিত হলে, নবী (সাঃ) পরে এই ব্যাপারে ব্যাখা দিয়ে বলেছিলেন যে চোখেঁর পানি ফেলা, কষ্ট পাওয়া  এসব সাধারণ ব্যাপার – যা আল্লাহকে অবমাননা করে না। তবে আমাদের এমন কিছু বলা উচিত না – যা আল্লাহকে অসন্তুষ্ট  করে।

আসমা বিনতে ইয়াযীদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর শিশু পুত্র ইবরাহীম ইন্তিকাল করলে তিনি নীরবে কাঁদেন। তাঁকে সান্ত্বনা দানকারী আবূ বাকর অথবা উমার (রাঃ) বলেন, আপনি আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ব রক্ষার ব্যাপারে  অধিক যোগ্য। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ চোখ অশ্রু বর্ষণ করছে, হৃদয় ব্যথিত হচ্ছে এবং আমরা এমন কিছু বলছিনা, যা আমাদের প্রভুকে অসন্তুষ্ট করে। যদি তা (মৃত্যু) অবধারিত না হতো, কিয়ামাতের দিন একত্র হওয়ার ওয়াদা না থাকত এবং পরবর্তীদের জন্য পূর্ববর্তীদের অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত না থাকতো, তাহলে হে ইবরাহীম! আমরা তোমার ব্যাপারে যে কষ্ট পেয়েছি, তার চেয়ে অধিক কষ্ট পেতাম। আমরা তোমার জন্য অবশ্যই দুঃখিত। {সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১৫৮৯}

এই সমাজে এমন অনেক জন আছে, যারা কেউ মারা গেলে নিজেদেরকে আঘাত করে করে বলে: আমি এখন কিভাবে বাঁচব? কে আমাকে চালাবে? আমার সাথে কেন এমন হলো? এইসব বলা বা চেঁচামেচি করে চুল টেনে ছেড়া ইত্যাদি – বিষয়গুলো আমাদের শরীয়াহ অনুমোদন দেয় না, কারণ এই সব বিষয়গুলি একজন মুসলিমের মর্যাদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

সর্বোচ্চ ৩ দিনের জন্য শোক

সুতরাং আমরা বুঝতে পারলাম যে, কান্না করা, দুঃখ প্রকাশ করা ইত্যাদি ইসলাম ধর্মে অনুমোদিত, কারণ এগুলোকে একটি মানুষের সাধারণ প্রতিক্রিয়া হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে, এই জীবনযুদ্ধ তো থমকে যেতে পারে না তাকে তো এগিয়ে যেতে হবে, সেজন্য এরকম অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তাই নবী (সাঃ) আমাদেরকে কারো মৃত্যুতে সর্বোচ্চ তিন দিন পর্যন্ত শোক পালনের অনুমতি দিয়েছেন। রাসুল (সাঃ) বলেছেন, ঐ ৩ দিন পর আমাদেরকে আবার দৈনন্দিন জীবনে ফিরে যেতে হবে। তবে, এই নিয়মের একমাত্র ব্যতিক্রম হিসেবে – স্বামীর মৃত্যুতে তার স্ত্রী চার মাস দশ দিন পর্যন্ত শোক পালন করতে পারে।

উম্মু হাবীবাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী  কোন মুসলিম নারীর জন্য কারো মৃত্যুতে তিন দিনের বেশি শোক পালন করা হালাল নয়। তবে স্বামীর মুত্যুতে চার মাস দশ দিন শোক পালন করবে। {সহীহ আল-বুখারী; হাদিস ৫৩৩৯}

এখন, তিন দিন শোক পালন করার অর্থ কী? আমরা এই ব্যাপারটাকে হতবাক হয়ে দিন পার করা, অস্বাভাবিক জীবনযাত্রা, বা প্রতিদিনের স্বাভাবিক নিয়মের উল্লেখযোগ্য বেচ্যুতি, ইত্যাদি – বিবেচনা করতে পারি, উদাহরণস্বরূপ:

  • খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে থাকা;
  • আজগুবি পোশাক পরিধান;
  • কাজ, অফিস বা নিয়মিত ব্যবসা ছেড়ে থাকা; অথবা
  • রান্না-বান্না ছেড়ে দেওয়া বা পরিবার পরিজনদের যত্ন নেওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া, ইত্যাদি।

একটি মানুষের মৃত্যুর কারণে এই সমস্ত জিনিসগুলি অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। তবে, উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলো নিছক উদাহরণ ছাড়া আর কিছুই নয় এবং বিভিন্ন উলামাগণ – দিন-কাল-পরিবেশ-অবস্থান ইত্যাদি বিবেচনা করে এইসব বিষয়গুলো ভিন্ন ভিন্ন রূপে আখ্যায়িত করতে পারে। আমাদের উচিত এরকম অবস্থানগুলো কাটিয়ে উঠা। তিন দিন অতিবাহিত করার পরে স্বাভাবিক নিয়মিত জীবনে ফিরে আসার জন্য আমাদেরকে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, কারণ অবশেষে আমাদের প্রত্যেককেই মৃত্যুবরণ করতে হবে এবং প্রতিটি মুসলিম বিশ্বাস করে যে, মৃত্যু এই জীবনেরই একটি অংশ।

তবে, আমাদেরকে খেয়াল রাখতে হবে যে, যখন একটি মৃত ব্যক্তির পরিবার, দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে নিমগ্ন আছে, তখন যেন তাদেরকে এই বিষয়গুলো শেখানোর চেষ্টা না করা হয়। সাধারণত, এমন সময়ে কি রকম প্রতিক্রিয়া করা উচিত, এই বিষয়ে কারো পরামর্শ গ্রহণ করার মতো মানসিক অবস্থা তাদের থাকে না। বরং, মানুষ যখন স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে তখন আমাদের এসব হাদিসের ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করে রাখা উচিত, যেন এসব ঘটনা ভবিষ্যতে কম ঘটে।

মৃতের জন্য কি করা যায়

  1. সর্ব প্রথম এবং সবচাইতে বেশী যা আমরা করতে পারি – আমরা তার জন্য প্রচুর পরিমাণে দুআ করতে পারি প্রতিবার যখন আমরা মৃত ব্যক্তিটির জন্য আমাদের মনে দুঃখ/কষ্ট অনুভব করবো, তখনই দুই হাত তুলে আল্লাহর (সুবহানাহু ওয়া তায়ালার) কাছে দোয়া করতে পারি, যেন আল্লাহ আমাদের সেই কাছের মানুষটির গুনাহ মাফ করে দেন, তাকে জাহান্নামের আগুন ও কবরের আযাব থেকে রক্ষা করেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কাছে প্রার্থনা করতে পারি যেন তিনি – জান্নাতে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন এবং তার কবরকে প্রশস্ত ও আলোকিত করে দেন।
  2. দ্বিতীয়ত, যদি সেই ব্যক্তিটির কোনো ঋণ থেকে থাকে, তাহলে আমরা তার ঋণের পুরো বা আংশিক পরিমাণ শোধ করার চেষ্টা করতে পারি এবং আল্লাহর কাছে আত্মাটিকে ক্ষমা করার জন্য অনুরোধ করতে পারি, তাহলে সেই মৃত ব্যক্তির উপকার হতে পারে। নিম্নবর্ণিত  আয়াতটিতে একটি মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার উত্তরিধারিকারের মাঝে সম্পত্তি বণ্ঠনের পূর্বে তার ঋণ শোধ করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে।

আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তান-সন্ততির (অংশ) সম্পর্কে নির্দেশ দিচ্ছেন, … (ঐসব বণ্টন হবে) তার কৃত ওয়াসীয়াত অথবা ঋণ পরিশোধের পর। … (এ বণ্টন) আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে, নিশ্চয় আল্লাহ মহাজ্ঞানী, প্রজ্ঞাশীল। {সূরা আন-নিসা: আয়াত ১১}

  1. তৃতীয়ত, আমরা মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে সদকা দিতে পারি। আমরা এতিম খানায় বা দরিদ্র লোকদের মাঝে কিছু টাকা-পয়সা বিতরণ করতে পারি এবং আল্লাহর (সুবহানাহু ওয়া তায়ালার) কাছে দুআ করতে পারি যেনো এর দ্বারা সেই মৃত ব্যক্তি উপকৃত হয় বা সওয়াব পায়। 

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ এক ব্যক্তি নবী করীম (সাঃ) কে বললেন, আমার মায়ের আকস্মিক মৃত্যু ঘটে, কিন্তু আমার বিশ্বাস তিনি (মৃত্যুর পূর্বে) কথা বলতে সক্ষম হলে কিছু সদকা করে যেতেন। এখন আমি তাঁর পক্ষ হতে সদকা করলে তিনি এর প্রতিফল পাবেন কি? তিনি [নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)] বললেন, হ্যাঁ {সহীহ আল-বুখারি ১৩৮৮}

ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত: সা‘দ ইব্‌নু ‘উবাদাহ (রাঃ) -এর মা মারা গেলেন এবং তিনি সেখানে অনুপস্থিত ছিলেন। পরে বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমার মা আমার অনুপস্থিতিতে মারা যান। আমি যদি তাঁর পক্ষ থেকে কিছু সদকা করি, তাহলে কি তাঁর কোন উপকারে আসবে?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ সা‘দ (রাঃ) বললেন, ‘তাহলে আমি আপনাকে সাক্ষী করছি আমার মিখরাফ্‌ নামক বাগানটি তাঁর জন্য সদকা করলাম।’ … {সহীহ আল-বুখারী ২৭৫৬}

সা’দ ইবনে উবাদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেনঃ আমি বললামঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ্! আমার মাতা ইন্তেকাল করেছেন, আমি কি তাঁর পক্ষ হতে সাদাকা করব? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। আমি বললামঃ কোন্ সাদাকা উত্তম? তিনি বললেনঃ পানি পান করানো(-র ব্যবস্থা করা)। {সুনান আন-নাসায়ী ৩৬৬৪}

  1. মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে হজ ও ওমরাহ করারও ইসলামে অনুমোদিত। কিন্তু আমরা এটি শুধুমাত্র তখনই করতে পারবো, যখন আমাদের নিজের বাধ্যতামূলক ফরজ হজটি আদায় হয়ে গিয়েছে। তবে, আমাদেরকে জেনে রাখতে হবে স্কলারগণ-এর মধ্যে এই বিষয়টি নিয়ে কিছুটা দ্বিমত রয়েছে।

ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ এক মহিলা নবী করীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) – এর নিকট এসে বলল, আমার মা হজ্জ করার মানৎ করেছিলেন। এরপর তিনি হজ্জ করার আগেই মারা গেছেন। এখন আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ্জ করব? উত্তরে তিনি বললেন, হ্যাঁ, তার পক্ষ থেকে হজ্জ কর। মনে কর যদি তার উপর ঋণ থাকত তাহলে কি তুমি তা আদায় করতে? সে বলল, অবশ্যই। তিনি বললেনঃ কাজেই তার উপর যে মানত আছে তা তুমি আদায় কর। আল্লাহ্‌ অধিক হক্‌দার, যে তাঁর জন্য কৃত মানত মানুষেরা পূর্ণ করবে। {সহীহ আল-বুখারি, হাদিস ৭৩১৫}

  1. আমরা সেই মৃত ব্যক্তির জন্য রোজা রাখতে পারি। আবদুল্লাহ খ. বুরাইদা (রাঃ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এক মহিলা এসে বলল, আমার মা মৃত্যুবরণ করেছেন, কিন্তু তিনি হাজ্জ আদায় করেননি। তার পক্ষে কি আমি হজ্জ আদায় করব? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, তার পক্ষে তুমি হজ্জ আদায় কর। {সহীহ আবু দাউদ, হাদিস ২৫৬১}
  2. আমরা সেই মৃত ব্যক্তির জন্য কুরবানী করতে পারি। আমরা বিসমিল্লাহ বলে আল্লাহর নামে একটি পশু কোরবানি দিয়ে, তার গোশত গরীবদের মধ্যে বিতরণ করে, আল্লাহর কাছে দুআ করতে পারি যেন সেই কুরবানীর প্রতিদান বা সওয়াব সেই মৃত ব্যক্তিটি পেয়ে যাক।
  3. আমাদের অবশ্যই ঘন ঘন কবর জিয়ারত করার চেষ্টা করতে হবে, সালামের সাথে অনেক পরিমাণে দুআ করতে হবে এবং তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। কবর যিয়ারত করা পুরুষদের জন্য মুস্তাহাব, কারণ সুলাইমান ইবনু বুরাইদা (রহঃ) হতে তার পিতা থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারাত করতে নিষেধ করেছিলাম। মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে তাঁর মায়ের কবর যিয়ারাত করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। সুতরাং তোমরা কবর যিয়ারাত কর। কেননা, তা আখিরাতের কথাকে মনে করিয়ে দেয়। {জামে’ আত-তিরমিজি, হাদিস নং ১০৫৪}

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তোমরা কবর যিয়ারত করো। কেননা, তা তোমাদেরকে আখেরাত স্মরণ করিয়ে দেয়। {সুনানে ইবনে মাজাহ; হাদিস ১৫৬৯}

জুতা পরে আমাদের কবরের মাঝখানে হাঁটা উচিত নয়।

উকবা বিন আমির (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, কোন মুসলমানের কবরের উপর দিয়ে আমার হেঁটে যাওয়া অপেক্ষা জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর দিয়ে অথবা তরবারির উপর দিয়ে আমার হেঁটে যাওয়া অথবা আমার জুতাজোড়া আমার পায়ের সাথে সেলাই করা আমার নিকট অধিক প্রিয়। কবরস্থানে পায়খানা করা এবং বাজারের মাঝে পায়খানা করার মাঝে আমি কোন পার্থক্য দেখি না। {সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ১৫৬৭}

আরেকটি হাদিস বশীর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। ..তিনি কতিপয় মুসলিমের ক্ববরের পাশ দিয়ে অতিক্রমকালে বললেনঃএরা প্রচুর কল্যাণ প্রাপ্ত হয়েছে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এক ব্যক্তিকে জুতা পরিহিত অবস্থায় কবরস্থানের উপর দিয়ে চলতে দেখে বললেনঃ হে জুতা পরিধানকারী! তোমার জন্য দুঃখ হচ্ছে, তুমি জুতা খুলে ফেলো। লোকটি রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর দিকে তাকালো এবং তাঁকে চিনতে পেরে সে তার পায়ের জুতা খুলে ফেলে দিলো। {সুনানে আবি দাউদ, হাদিস ৩২৩০}

  1. আমরা সেই মৃত ব্যক্তির বন্ধু এবং আত্মীয়দের সাথে দেখা করতে পারি যা আমাদের নবী (সাঃ) নিজেই করতেন। আমাদের ধর্মে এই ব্যাপারটিকে উৎসাহিত করা হয়েছে, কারণ আমরা সবাই জানি যে আমাদের নবী মুহাম্মদ (সাঃ) তার স্ত্রী খাদিজা (রাঃ)- এর মৃত্যুর পর তার বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যেতেন।
  2. যদিও এই ব্যাপারে স্কলারদের মধ্যে কিছু মতভেদ রয়েছে যে মৃত ব্যক্তির জন্য কুরআন তিলাওয়াত করা যায় কিনা, তবে অধিকাংশ আলেম এই ব্যাপারে অনুমতি দিয়েছেন। তবে আমরা অবশ্যই কোন নির্দিষ্ট সূরা বা নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যায় কোনো আয়াত বার বার পড়া ইত্যাদি থেকে নিজেদেকে বিরত রাখবো (যদিনা কোনো সহীহ সূত্রে এমনটি করার রেফারেন্স পাওয়া যায়)। 
  3. কারো মৃত্যুতে আমাদের সর্বোত্তম চেষ্টা করা উচিত একটি বড়ো জানাযার ব্যাবস্থা করা, কারণ যেই জানাযায় ১০০ জন মুসলিম অংশগ্রহণ করে সেই জানাযায় মৃত ব্যক্তির ক্ষমা পাওয়ার সম্ভবনা বেড়ে যায়। নিচের হাদিসটি বিশ্লেষণ করলে আমরা এই বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারবো ইনশা আল্লাহ্:

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, মুসলমানদের মধ্যে এমন কোন মৃত ব্যক্তি নেই যার উপর এমন একদল মানুষ জানাযার সালাত আদায় করে যাদের সংখ্যা একশতে পৌঁছে যায় আর যারা তার সম্পর্কে সুপারিশ করে তাদের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে না। {সুনান আন-নাসায়ী ১৯৯২}আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, এক শত মুসলমান কারো জানাযার সালাত পড়লে তাকে ক্ষমা করা হয়। {সুনানে ইবনে মাজাহ; হাদিস ১৪৮৮}