Islam-beliefs

সুরাহ আসর – তাফসীর

عَصۡرِ আসর শব্দের অর্থ সময়। আমাদের ৫ ওয়াক্তের নামাজের মধ্যে আসর এমন একটি ওয়াক্ত যা অন্যান্য সব ওয়াক্ত থেকে সবচাইতে ব্যস্ততম সময়, যখন সূর্যের আলো শেষ সময়ের কাছে চলে আসে (মাগরিব ও এশার ওয়াক্তের এর কাছে)। তাই, এই সময়টি খুব দ্রুত গতিতে কেটে যায়।

আসর শব্দটির একটি রুট শব্দ হলো اَعۡصِرُ অসীর। সূরা ইউসুফ আয়াত ৩৪এ এই শব্দটি ফল থেকে জুস বের করা বুঝতে ব্যবহৃত হয়েছে। এটি ইঙ্গিত করে যে, এই সময় এমন ভাবে প্রবাহিত হতে থাকে যে আমরা এটি ধরে রাখতে বা থামিয়ে রাখতে পারি না।

وَٱلۡعَصۡرِ ওয়াল আসর এর অর্থ- আল্লাহ (সুবহানু  ওয়াতালা) শপথ করেছেন  সময়ের উপর। আল্লাহ এই সময়ের উপরে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন যে মানুষ خُسۡ খুসর এ আছেন, অর্থাৎ ক্রমাগত ক্ষতি ও ধ্বংসের মধ্যে ডুবে আছে। আমরা প্রতিনয়ত এই সময় তো হারাচ্ছি তার সাথে নিজেদের সত্যিকারের সাফল্যও থেকেও দূরে চলে যাচ্ছি। 

এই ব্যাপারটি এভাবেও বিশ্লেষণ করা যায় যে সময় আল্লাহ সুবহানু ওয়াতায়ালার এমন একটি সৃষ্টি যা, সর্বকালীন অবিচলিত সাক্ষী হিসেবে সব প্রজন্মের মানব জাতিকে সময়ের সাথে সাথে সত্যিকার সাফল্য হারাতে দেখে যাচ্ছে।

তবে আল্লাহ সুবহানু ওয়াতায়ালা বলেছেন যে, এই প্রতিনিয়ত ক্ষতির একটি মাত্র ব্যতিক্রম আছে:

আল্লাহ সুবহানু ওয়াতায়ালা বলেছেন চারটি শর্ত বা বিষয়ের সম্মিলনে আমরা এই ক্রমাগত ক্ষতির বেতিক্রম ঘটাতে পারি। যদি কোনো মানুষ মনে করেন যে সম্পত্তি, ক্ষমতা, বিনোদন, ইত্যাদি হলো সাফল্যের চাবিকাঠি আর এগুলোর পিছে দৌড়াতে থাকে, এমনকি যদি এসব অর্জন করতেও সক্ষম হয়ে যায়, তবুও সেই বেক্তি ক্ষতির দিকেই ঢেলে পড়তে থাকে আর তাদেরকে এই ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের শ্রেণীর আওতায়ই ধরা হয়। সুতরাং, একমাত্র ব্যতিক্রম মানুষ হলো তারাই, যারা এই ৪টি শর্ত পূরণ করতে পারবে এবং নিজেকে সেই ক্ষতি থেকে বাঁচিয়ে প্রকৃত লাভবান হতে পারবে:

  1. ِّإِلَّا الَّذِينَ ءَامَنُو ইল্লাল্লাজিনা আমানু – এর অর্থ – সেই সকল ব্যাক্তি ব্যতীত যারা ঈমান এনেছে – যারা আল্লাহ সুবহানু ওয়াতায়ালার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে। যদিও ইমানের ছয়টি স্তম্ভ রয়েছে তবে এর মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো আল্লাহ সুবহানু ওয়াতাআলার উপর বিশ্বাস স্থাপন করা। ইমানের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো, বিচার দিনের উপর বিশ্বাস রাখা – আমরা যদি পরকালে বিশ্বাস রাখি, তাহলে এই পৃথিবীর দারিদ্র, সমস্যা ও দুঃখ-দুর্দশা সহনীয় হয়ে যায়। এমনকি মানুষ অনৈতিক অর্থ-সম্পদ ও অশুভ প্রলোভন থেকেও নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারে।

و ওয়া শব্দটির অর্থ হলো “এবং” – তার মানে শুধুমাত্র মনে ঈমান থাকাই যথেষ্ট না

  1. عملواٱلصلحت আমিলুস সোয়ালিহাত – এর অর্থ – সেই সকল ব্যাক্তি ব্যতীত যারা সৎকর্ম করে। তাদের হৃদয়ে ঈমান থাকবে এবং তাদের কার্যকলাপ হবে সৎ। ভালো কাজ করা এবং খারাপ কাজ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখা এই দুইটিই সৎকর্মের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। শুধুমাত্র আল্লাহ সুবহানু ওয়াতাআলাই সঠিকভাবে বলে দিতে পারে কোনটি ভাল কাজ আর কোনটি খারাপ, কারণ আমাদের নৈতিকতার মানদণ্ড ব্যক্তি, স্থান ও সময় সাপেক্ষে পরিবর্তিত হতেই থাকে।

আবার و ওয়া বা এবং শব্দটি ব্যাবহার করে বুঝানো হয়েছে, যে শুধু নিজে ভালো কাজ করলেই হবে না।

  1. تَوَاصَوۡاْ بِٱلۡحَقِّ তাওয়া সাউবিল হাক্ব – এর অর্থ – যারা অন্যকে সত্যের পথে চলতে বা সৎকর্ম করতে উৎসাহিত করে। আমরা শুধু নিজে নিজেই ভাল কাজ করে গেলে হবে না – আমাদের অবশ্যই অন্য মানুষদেরকেও সত্যের পথে দাওয়াত দিয়ে তাদেরকে নেয়নিষ্ঠ হতে উৎসাহিত করতে হবে – অর্থাৎ, তাদের মনে ঈমানের আলো বৃদ্ধি করে, তাদেরকে ভাল কাজে অটল থাকার এবং খারাপ কাজ করা থেকে বেঁচে থাকার পরামর্শ দিতে হবে। আমাদের অবশ্যই সম্মিলিত ভাবে আল্লাহর তাকওয়া এর সাথে তাঁর উপদেশ গুলো মেনে চলার ও তাঁর নিষেধাজ্ঞাগুলো এড়িয়ে চলার যথাসাধ্য চেষ্টা করে যেতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া আমরা কখনোই অন্য কাউকে অনুপ্রাণিত করতে পারবো না আর আমরা নিজেরাও আরও স্বার্থপর হয়ে যাবো – এভাবে ভাল মানুষগুলোও সময়ের সাথে সাথে খারাপ মানুষগুলোর সংস্পর্শে থেকে খারাপ কাজে প্রভাবিত হওয়ার ঝুঁকি রাখে।

আবারও و ওয়া বা এবং শব্দটি ইঙ্গিত করে যে উপরের সবগুলো করলেও তা যথেষ্ট হবে না,  সেই প্রতিনিয়ত ক্ষতির ব্যতিক্রম হতে হলে এই চারটি শর্তের কোনো একটিও বাদ দিলে চলবে না

  1. تَوَاصَوۡاْ بِٱلصَّبۡرِ তাওয়া সাউবিস সবর – এর অর্থ – যারা অন্যকে সবরের পরামর্শ দেয়। আরবি শব্দ সবর-এর সাধারণ অনুবাদ হলো “ধৈর্য ধারণ করা”। আসলে এই শব্দের অর্থ আরও ব্যাপক – এই একই শব্দের অর্থের মধ্যে রয়েছে সহনশীলতা, ধৈর্য-ধারণ, ​​অধ্যবসায় এবং সংযম। সুতরাং, যখন কাউকে কোন দুর্যোগ দিয়ে পরীক্ষা করা হয় তখন আমাদের উচিত সেই ব্যাক্তিকে সবর-এর মাধ্যমে ধৈর্য ধারণ করার জন্য উপদেশ দেওয়া। তাকে উৎসাহিত করা উচিত, যেন তিনি সেই অবস্থায় আল্লাহের প্রোতিদানের আশায় ন্যায়পরায়ণতা বজায় রেখে, নিষিদ্ধ জিনিস বা কর্মে লিপ্ত না হয়ে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালার লিখিত ভাগ্য বা কদরের উপর সন্তুষ্ট থাকে। আমাদের অবশ্যই একে অপরকে বার বার মনে করিয়ে দিতে হবে যে জগতের প্রত্যেকটি ঘটনাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালার অনুমতি সাপেক্ষেই ঘটে। অধ্যবসায় এর অর্থ যখন খারাপ সময় আসে, তখন আমরা যেন থমকে না গিয়ে চলতে থাকি, আমাদের একে-অপরকে অনুপ্রেরিত করা উচিত যেন আমরা হতাশ না হয়ে পড়ার এই রকমের মনোভাব গড়ে তুলতে পারি।

এই সুরাহটির একটি উল্লেখযোগ্য লক্ষণীয় বিষয় হলো, যদি কোনো ব্যেক্তি কোনো কাজ না করে সময় অতিবাহিত করে, যদি সে কোনো খারাপ কাজ বা গুনাহও না করে, তবুও তাকে ক্রমাগত এই ক্ষতির আওতায় অন্তর্ভুক্ত ধরা হয়।

শয়তানের ভূমিকা

শয়তানের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো যত বেশী সম্ভব মানব জাতিকে পথভ্রষ্ট করে চূড়ান্ত ক্ষতির পথে পরিচালিত করে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়া। সুতরাং, এই ক্ষেত্রে শয়তান চারটি কাজ করার চেষ্টা করে:

  1. প্রথমত শয়তান আমাদের ইমানকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে;
  2. শয়তান যদি আমাদের ঈমান নষ্ট করতে না পারে, তাহলে সে আমাদেরকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করে যে, যতক্ষণ আমাদের মধ্যে ঈমান আছে, আমাদের আর কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নাই। এভাবে সে আমাদের সৎকর্ম থেকে বিরত রাখে;
  3. শয়তান যদি আমাদের ঈমান ও আমল ধ্বংস করতে অক্ষম হয়, তাহলে সে আমাদেরকে স্বার্থপরের মতো শুধু নিজে নিজেই ভালো কাজ করে যেতে উৎসাহিত করে, যেন আমরা অন্য মানুষদের ব্যাপারে খেয়াল না করি। শয়তান চেষ্টা করতে থাকে, যেন আমরা অন্যদেরকে সত্যের পথে আকৃষ্ট করে দাওয়াত দিয়ে তাদেরকে নেয়নিষ্ট পথে অটল থাকার জন্য তাদের সাহায্যে এগিয়ে না যেতে পারি;
  4. শয়তান যখন উপরের সমস্ত চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে যায়, তখন অবশেষে সে আমাদের সময় নষ্ট করার চেষ্টা করে। সে তখন শুধু চেষ্টা করে যেন আমরা কিছু না করেই শুধু ফুর্তিতে থেকেই আমাদের সময় অতিবাহিত করে দেই। শয়তান আমাদের মনে এমন চিন্তা আনে যে, “অন্তত আমি কোনো খারাপ কাজ করছি না”। সময়ের গুরুত্ব অবহেলা করানো শয়তানের আরেকটি ফাঁদ, আর এই সুরাহাটি আমাদেরকে সময়ের মূল্যবোধ মনে করিয়ে দেয়।

শয়তান প্রথমে আমাদের ঈমান তারপর আমল নষ্ট করার চেষ্টা চালায়, তারপর চেষ্টা করে যেনো ইসলামের সত্য প্রচার না হয় আর চেষ্টা করে যেনো আমরা সত্যের পথে আমরা একে অপরকে সহায়তা করতে না পারি। শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুই ঠেকাতে না পারলে আমাদের সময় নষ্ট করার চেষ্টা করে।

উদাহরণস্বরূপ একটি ঘটনা

ধরুন, আমরা একটি বিশাল জাহাজে ঘুমিয়ে আছি। একের পর এক জন কে ঘুম থেকে উঠানো হচ্ছে।  আমাদের সম্পূর্ণ স্মৃতিগুলি মুছে ফেলা হয়েছে তাই আমরা জানি না যে আমরা কেন এবং কীভাবে এই জাহাজটিতে আসলাম। জাহাজের বাহিরে কি ঘটছে তা ভিতর থেকে দেখা যায় না। হটাৎ, আপনি জানতে পারলেন যে জাহাজটি আসলে ডুবে যাচ্ছে এবং সমুদ্রের সর্বনিম্ন প্রান্তে পৌঁছে গেলেই এটি ধ্বংস হয়ে যাবে, তাই আমাদের জীবনের খুব বেশি একটা সময় বাকি নেই। আপনি এটাও জানতে পারলেন যে, এই জাহাজের একটি নিরাপদ চেম্বার আছে, আপনি যদি সেখানে পৌঁছাতে পারেন, শুধুমাত্র তাহলেই আপনি বেঁচে যেতে পারবেন।

এই জাহাজের অন্যান্য সদস্যরা ইতিমধ্যেই বিনোদনের মধ্যে ডুবে আছেন, কারণ তারা মনে করছেন যে জাহাজটির কিছুই হবে না, আর তারা কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই এই জাহাজটিতে অবস্থান করছেন – তাই তারা আনন্দ উপভোগ করে সময় কাটাচ্ছে।

অন্যদিকে, আপনি বুঝতে পেরেছেন যে, ওই নিরাপদ চেম্বারটি আসলে বিনোদন এর রুমের ঠিক উল্টো দিকে অনেক দূরে অবস্থিত, আর সেই রুমটিতে ঢুকতে হলে নিম্নবর্তীত শর্তগুলো পূরণ করতে হবে:

  1. পার্টি বাদ দিয়ে সেই রুমের দিকে দৌড়াতে হবে।  এবং সেখানে প্রবেশ করতে সেখানে
  2. কঠোর পরিশ্রম করতে হবে
  3. রুমের দরজাটি খোলার জন্য একাধিক আঙ্গুলের ছাপ প্রয়োজন – তাই আপনার নিজেকে বাঁচাতে হলে, আরও কয়েকজন মানুষকে আপনার সঙ্গে সেখানে নিয়ে যেতে হবে

সুতরাং, আপনার তাদেরকে এমনভাবে উৎসাহিত করতে হবে যেন তারা পার্টি ছেড়ে, কঠোর পরিশ্রম করে সেই নিরাপদ চেম্বারটিতে পৌঁছাতে পারে। তাহলেই আপনি আপনার অনুসারীদের সাহায্যে একাধিক আঙুলের ছাপ দিয়ে রুমটিতে অ্যাক্সেস নিতে পারেন, যা কিনা আপনাদের একমাত্র আশ্রয়। আপনাকে চেষ্টা করতে হবে যেন আপনার অনুসারীরা উপলব্ধি করতে পারে যে তাদেরকে কঠিন পরিশ্রম করে সেই রুমটিতে পৌঁছুতে পারে এবং তাদের বিনোদন, পার্টি, ইত্যাদি বেঁচে যাওয়ার পরেও করতে পারবে – এগুলো না বিশ্বাস করলে তারা কখনোই আপনাকে অনুসরণ করবে না। এই সূরাটিতে এমনি একরকমের অবস্থা লক্ষ্য করা যায়।